বাংলাদেশে অনুদান, সুদবিহীন ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে ২০০ কোটি ডলার দিতে চীন সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় চীনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে ১৬ জুলাই মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে চীনা দূতাবাস। এতে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। দূতাবাসের অন্য কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশের ৫০০ কোটি ডলার সহযোগিতার প্রত্যাশা সম্পর্কে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আর্থিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে চীন। ২০০ কোটি ডলার সহযোগিতার বিষয়ে চীন একমত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অনুদান, সুদবিহীন ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণ। এটি আমাদের সমন্বিত আর্থিক সহযোগিতা প্যাকেজ।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান হলো প্রত্যাবাসন। বহু দিন ধরে বিষয়টি প্রলম্বিত হচ্ছে। চীন গত বছর থেকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে।উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত বছর মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত শুরু হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। সেখানকার পরিস্থিতি এখন নিরাপদ নয়।’ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভূমিকা রাখতে চীন প্রতিশ্রæতিবদ্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি কেবল চীনের দায়িত্ব নয়, জাতিসংঘ, ভারতসহ অন্যদেরও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর সফল হয়নি বলে বিরোধীরা যে মন্তব্য করছেন, সে বিষয়ে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘অন্যরা কী বললেন এটি তাদের মূল্যায়ন, এ নিয়ে আমি মন্তব্য করতে পরি না। তবে আমাদের মূল্যায়ন হলো, সফর অত্যন্ত সফল হয়েছে। সম্পর্কের উন্নতি, ২১টি সমঝোতা স্মারক সই, আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রæতি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা, ২০২৬ সালের পরও ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা, চীনে আম রপ্তানিসহ অনেক বিষয়ে সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া আগামী বছর দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা আরও বাড়বে।’ চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী বলে এ সময় উল্লেখ করেন তিনি।
রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তাব সম্পর্কে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এটিই সাধারণ যে, আপনি আপনার চাহিদা তুলে ধরবেন, আর আমরা দেখব এ ক্ষেত্রে কোথায় ঐকমত্যে আসতে পারি।’
রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘তিস্তা নিয়ে আমাদের অবস্থান খুবই পরিষ্কার। প্রকল্পটি বাংলাদেশের। এ প্রকল্প কীভাবে হবে, তা বাংলাদেশ ঠিক করবে। বাংলাদেশ যে সিদ্ধান্তই নিক, তা আমরা সম্মান করব।’ আর্থিক বিষয়ে আলোচনা করতে চীনের কারিগরি দল কবে আসছে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় বলা যাবে না, ঠিক কখন ও কবে কারিগরি দল আসবে। বিষয়টি ওয়ার্কিং কমিটি দেখভাল করবে। তবে আমরা দ্রæত এটি চূড়ান্ত করতে চাই।’
মোংলা বন্দর নিয়ে প্রশ্ন করলে ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘মোংলা বন্দর আধুনিকায়নে বাংলাদেশ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এ দেশের সরকারই ঠিক করবে, কখন আমরা কাজ করব।’ এ বিষয়ে চীন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান তিনি।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিফিং সম্পর্কে জানতে চাইলে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমার সংবাদ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের ওপর। এর সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করব না। তবে আমরা বিশ্বাস করি, এর সমাধান সম্ভব। সরকারের যথেষ্ট প্রজ্ঞা রয়েছে এটি সমাধানের।’
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘এ সফরের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরও উচ্চ পর্যায়ে গেছে। এই সম্পর্ক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে নিতে দুই দেশের নেতারা একমত হয়েছেন। এটি সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ফল।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চীন সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ভিশন ২০৪১-এর উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নে পাশে থাকবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং জাতীয় স্বার্থে উন্নয়নের পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাকে সম্মান করে বেইজিং। আর বাংলাদেশও এক চীন নীতির বিষয়ে প্রতিশ্রæতির কথা আবারও জানিয়েছে। পুরো চীন অর্থাৎ তাইওয়ান চীনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বলে বাংলাদেশ তার অবস্থানের কথা জানিয়েছে।’
ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘দুই দেশের বৈঠকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ (জিডিআই), বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ (জিএসআই) এবং বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগ (জিসিআই) নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চীন জিডিআই নিয়ে তার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে জানাতে প্রস্তুত।’
ঢাকা-বেইজিং বৈঠকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ ও চীন একমত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুই দেশ রোহিঙ্গা, জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, গাজা সংকট, মানবাধিকার রক্ষা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভবিষ্যৎ এশিয়া ও মানবকল্যাণে একত্রে কাজ করার বিষয়ে একমত। চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের থেকে ওপরে। এখন যৌথভাবে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা, স্থিতিশীলতা, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিন্ন স্বার্থকে সুরক্ষা দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দুই দেশ প্রতিশ্রæতিবদ্ধ।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘দুই দেশ অবকাঠামোগত এবং নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে সম্পর্ক আরও গভীর করতে একমত হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনে উৎসাহিত করেছে। দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি নিয়ে দ্রæত সময়ের মধ্যে আলোচনা শুরু করতে দুই দেশ একমত হয়েছে। চলতি বছরই দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে।’ তিনি বলেন, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় অঞ্চলের ভারসাম্য ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগকে (সিডি) সমর্থন করে চীন।’
আপনার মতামত লিখুন :