বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

সমাজকল্যাণের সাবেক অর্থ মন্ত্রী ও এপিএসরা লুটে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা

আইন-অপরাধ ডেস্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪, ১০:২৮ এএম

সমাজকল্যাণের সাবেক অর্থ মন্ত্রী ও এপিএসরা লুটে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা

সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয় থেকে সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামান ও তার এপিএস মিজান নানারকম ফন্দিফিকির করে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। এসব টাকা গরীব-দু:স্থ ও সমাজের উন্নয়ন খাতের। নানারকম খাতের নামে বরাদ্দ আসা টাকাই লুট করেছে। আর এ লুটপাটের জন্য নানারকম ভুয়া তালিকা, বিলভাউচার ও প্রকল্প দেখানোর নাম করে লুটেছে তারা। 
মন্ত্রণালয়ের সুত্রগুলো জানায়, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ নিজের আত্মীয়স্বজনকে তুষ্ট করে দরিদ্র মানুষকে ঠকিয়েছেন। মন্ত্রীর মেয়ে, জামাতা, মন্ত্রীর স্ত্রীর ভাতিজারাসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন পেয়েছেন গরিবের জন্য সরকারি বরাদ্দ অর্থ সহায়তা। দুস্থ নন, শুধু দলীয় পরিচয়ে এমন শতাধিক ব্যক্তি পেয়েছেন অনুদানের মোটা অঙ্কের টাকা।যা বরাদ্দের তালিকা খোজ করলেই বের হবে নানারকম ভুয়া নাম।
সমাজকল্যাণ পরিষদের তথ্য তালিকা থেকে জানা যায়, সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের বোন নূরন নাহার আনোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। বিশেষ অনুদানপ্রাপ্ত দুস্থ ও অসহায় ব্যক্তিদের তালিকায় তার নাম রয়েছে। একই তালিকায় নূরন নাহারের মেয়ের জামাই মোহাম্মদ জাভেদ চৌধুরীরও নাম রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে তাদের। কালীগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চনশ্বর গ্রামের বাসিন্দা সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রীর স্ত্রীর ভাতিজা গোলাম মোস্তফা, আবু সাঈদ খান, আবু জাফর খান এবং স্ত্রীর আরেক ভাতিজা গোলাম ফারুকের পরিবারের ১০ জন সদস্য পেয়েছেন দুস্থদের সহায়তার টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকাতেও কালীগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চনশ্বর গ্রামে নুরুজ্জামান আহমেদের স্ত্রীর ভাতিজা গোলাম মোস্তফা, গোলাম ফারুক,আবু সাঈদ খান, আবু জাফর খানসহ তাদের পরিবারের ১৬ ব্যক্তির নাম রয়েছে। এ অর্থবছরে মোট ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা পেয়েছেন তারা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও গোলাম ফারুকদের পরিবারের ১০ সদস্য আবার সহায়তার টাকা পেয়েছেন।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা লিটন মিয়ার শ্বশুর মোহাম্মদ হোসেন, তার শাশুড়ি, স্ত্রী ও স্ত্রীর চার বোন গত তিন অর্থবছরে প্রায় ২ লাখ টাকা পেয়েছেন। যদিও লিটনের শ্বশুর কালীগঞ্জের দক্ষিণ দলগ্রামে মোহাম্মদ হোসেন একজন সচ্ছল কৃষক।
কালীগঞ্জের গোপাল রায় গ্রামের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ইনসানা বেগম ও তার স্বামী জেলা যুবলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মনজু আলী শেখ ২০২১-২২ অর্থবছরে দুবার করে মোট ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পেয়েছেন। ওই তালিকায় দেখা গেছে, দুস্থ নন, শুধু দলীয় পরিচয়ে এমন শতাধিক ব্যক্তি অনুদান পেয়েছেন।
এ ছাড়া কালীগঞ্জের তুষভান্ডার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু তালেব আলবানী, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রীর এপিএস মিজানুর রহমান মিজানের শ্বশুর। আবু তালেবসহ তার স্ত্রী মুসারত রেহেনা ও ছেলে ফুয়াদ হাসানের নাম আছে ২০২১-২২ অর্থবছরের অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকায়। আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা গ্রামের আশিক বাবু বলেন, মন্ত্রীর এপিএস মিজানুর রহমানের চাচাতো ভাই। তার নামও আছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে অনুদাপ্রাপ্তদের তালিকায়। আশিকের দাবি, এপিএস মিজান তার কাছ থেকে একটি মাদ্রাসার নিয়োগ বাবদ ৭ লাখ টাকা নেন। কিন্তু চাকরি না হলে অনুদানের দুটি চেক দিয়ে ১ লাখ টাকা পরিশোধ করেন।
আদিতমারীর মহিষখোঁচা ইউনিয়নের দেলজার রহমানের নামে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ হলেও তিনি সেই টাকা পাননি। দেলজারের দাবি, এপিএস মিজানুরের মামা সেকেন্দার আলী তাকে দিয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংকে হিসাব খুলে নিয়েও টাকা দেননি। আরও অনেকেই বলেছেন, তালিকায় তাদের নাম থাকলেও টাকা পাননি। কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সদ্য বিদায়ী কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক তাদের টাকা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা আত্মগোপনে গেছেন। ফলে অভিযোগের বিষয়ে সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও তার এপিএসের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ ওই প্রতিষ্ঠান দুস্থ ও অসহায় ব্যক্তিদের চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ও গৃহ মেরামত বাবদ সহায়তা দেয়। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লালমনিরহাট জেলার ১ হাজার ৬৩১ জন ব্যক্তিকে ২ কোটি ৫০ লাখ ৯২ হাজার টাকা বিশেষ অনুদান দেওয়া হয়েছে। নুরুজ্জামান আহমেদ ২০১৬ সালে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১৯ সালে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০২৪ সালের মন্ত্রিসভায় তিনি বাদ পড়েন। তিনি ২০১৪ সাল থেকে লালমনিরহাট-২ (কালীগঞ্জ-আদিতমারী) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।
কাঠমিস্ত্রির পোলা এপিএস মিজানের অর্থ-সম্পদের পাহাড়!
এদিকে মন্ত্রীর এপিএসের সুবাধে একজন কাঠমিস্ত্রির পোলা তার সারাজীবনের আখের গুছিয়ে নিতে সুস্থ-সবল মানুষকেউ অসুস্থ দেখিয়ে তার চিকিৎসা ভাতার অর্থও লুটে নিয়েছেন। তিনি একইসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকা কমিশন হাতিয়ে নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ভুয়া প্রতিবন্ধীদের নামে নেয়া ভাতাও তার পেটে গেছে। মাত্র কয়েক বছরে এপিএস মিজানের অর্থ-সম্পদের তথ্য দেখে দলের কেউকেউ হয়েছেন চরকগাছ। তিনি হলেন সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের এপিএস মিজানুর রহমান মিজান। ওরফে কাঠমিস্ত্রির পোলা মিজান। ড়তনের আগপর্যন্ত লালমনিরহাট জেলায় তাকে সাবেক মন্ত্রীর চেয়ে বেশী সমিহ করছেন এলাকার জনগন। হত দরিদ্র কাঠমিস্ত্রির পোলা মিজান কি এমন আলাদিনের চেড়াগ হাতে পেয়েছিল এটাই সবার কাছে এখন বড় প্রশ্ন?।লালমনিরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজমকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের এই সাবেক এপিএস মিজানের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় থাকাকালিন একের পর এক আলোচনা সমালোচনার মুখোমুখি হলেও কেউ টু শব্দটিও করতে পারেনি। কখনো মাদ্রাসার জমি দখল নিয়ে, গাড়িতে মাদকের চালান ধরা পড়া নিয়ে, আবার তিস্তা নদীর বালু নিয়ে এমন আরও বিভিন্ন সমালোচিত কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। ক্ষমতা ভোগের সময় অভিযোগ রয়েছে টর্চারসেলও নাকি তার ছিলো। এপিএস থাকাকালিন তার অপ্রতিরোধ্য অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই মিজান বাহিনীর নির্যাতন নেমে আসত। 
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, বিভিন্ন দপ্তরের নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্য, বদলীসহ সরকারি বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে উৎকোচ গ্রহণ এবং হাজার হাজার সুস্থ মানুষকে অসুস্থ’ বানিয়ে সরকারি চিকিৎসা সহায়তার নামে সমাজকল্যাণ মন্ত্রালয়ে থেকে টাকা পাইয়ে দিয়ে রোগীপ্রতি ২০হাজার টাকা অর্থগ্রহণ  করতেন তিনি। মাদ্রাসার জমি দখলও তিনি করেছেন। অভিযোগ ছিলো তার স্ত্রীর গাড়ীতে মাদক বহন করা হত। এছাড়াও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অবৈধ ভাবে তিস্তা নদী থেকে বালু উত্তোলনের প্রায় ৮০% অর্থগ্রহণ ও বিভিন্ন ভাতা পাইয়ে দিয়ে উৎকোচ নিয়েছেন তিনি। এসব অপকর্ম সহযোগিতার জন্য তার রয়েছে সাবেক ও বর্তমান আদিতমারী-কালিগঞ্জ উপজেলা ও লালমনিরহাট  জেলায় ছিল নিজস্ব বাহিনী।     
সাবেক এই এপিএস মিজানের গ্রামের বাড়ি মহিষখোঁচা ইউনিয়নের বারোঘড়িয়া (বাবুপাড়া) গ্রামে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এপিএস হওয়ার পরপরেই তার বাড়ি টিনের ছাপড়া ভেঙ্গে কোটি টাকা ব্যয়ে রাজপ্রাসাদের ন্যায় দ্বিতল বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেন। বাড়ির সামনে দিয়ে পথচারিরা যাওয়ার বলছে কাঠমিস্ত্রির পোলা এপিএস মিজানের লুটের টাকার প্রসাদ। তার রয়েছে নিজ গ্রামসহ লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ১০ থেকে ১১ একর কৃষিজমি, বিভাগীয় শহর রংপুরের রয়েছে ২০ কোটি টাকা মূল্যের ২০ শতক জমি, রাজধানী ঢাকায় রয়েছে তার একাধিক ফ্ল্যাট, অভিযোগ আসছে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে তার প্রায় ২৫ কোটি টাকা মূল্যের একটি  ক্রয় করা বাড়ি । এই বাড়িতেই তার স্ত্রী ও সন্তান স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। এছাড়াও নিকটতম পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের একাউন্টে নামে-বেনামে জমা রয়েছে বিপুল পরিমান অর্থ। অভিযোগের সার্বিক বিষয় নিয়ে সাবেক এপিএস মিজানের সাথে মুটো ফোনে যোগাযোগের চেষ্টাও করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!