অন্তর্র্বতী সরকারের প্রথম ১০০ দিনে যে কয়েকটি ঘটনা আলোচনার শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে এর অন্যতম ‘ঢালাও মামলা’। জুলাই–আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকান্ডের ঘটনায় দেশজুড়ে এখন পর্যন্ত হওয়া ঢালাও মামলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা সম্পর্কে আসামিদের সিংহভাগ কিছুই জানেন না। বাদী চেনেন না আসামিকে, আসামিরাও চেনেন না বাদীকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে বাদী নিজেও ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
এমনও অভিযোগ উঠেছে, শত শত মানুষকে আসামি করে মামলা দিতে বাদীকে বাধ্য করা হয়েছে, কখনো দেখানো হয়েছে টাকার প্রলোভনও। পূর্বশত্রুতা,রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা এবং চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতে অনেককে আসামি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। মামলায় কাদের আসামি করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে বাদীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, নিয়ন্ত্রণ থাকে অন্যদের হাতে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীসহ সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে‘ গায়েবি’ মামলা দিত পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতারা। এখন দেখা যাচ্ছে,হত্যা মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হচ্ছে‘ ইচ্ছে মতো’।সরকার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, এসব মামলায় নিরীহ কাউকে যেন হয়রানি না করা হয়, প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়া না গেলে কাউকে যেন গ্রেফতার করা না হয়।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অনেককেই এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে বা এখনো করা হচ্ছে। আবার ঘটনার সঙ্গে দূরতম সম্পৃক্ততা না থাকলেও আসামি হয়ে নিরপরাধ অনেকে গ্রেফতারের ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন,৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দায়ের হওয়া মামলাগুলো যথাযথভাবে তদন্ত করতে হবে। কোনো নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা যাবে না, কোনো পুলিশ সদস্যকেও অযথা ভিকটিমাইজ করা হবে না। নিরীহ কারো নামে মামলা হলেও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অভিযোগ উঠেছে,কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা করার আগেই টার্গেটকৃত ব্যক্তির কাছে চাঁদা হওয়া হয়েছে। চাঁদা না দিলে মামলায় আসামি করা হয়েছে, আর চাঁদা দিলে আসামি করা হয়নি। আবার মামলার পর আসামির তালিকা থেকে নাম কাটাতেও লাখ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে, কিংবা এখনো নেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার মামলা দেওয়ার পাশাপাশি অনেকের বাড়ি,জমি,প্লট, দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও দখল করে নেওয়া হয়েছে।
লুট করা হয়েছে মালামাল।আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। যার প্রতিষ্ঠান লুট বা বেদখল করা হয়েছে, উলটো আবার তার বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম ইতিমধ্যে একাধিকবার বলেছেন, ঢালাও মামলা দিয়ে বাণিজ্য করার বহু অভিযোগ তারা পেয়েছেন। মামলা দিয়ে বাণিজ্য করা যাবে না বলেও তিনি সতর্ক করেন।
রাজধানীর শ্যামপুর-কদমতলী এলাকার এক ভুক্তভোগী জানান, ৫ আগস্ট বিকাল থেকেই ওই এলাকায় লাল মসজিদের সামনে থাকা তার কদমতলী স্টিল মিল ও ওয়্যার হাউজ ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্টিল মিলে থাকা ১০০ টন রড ও লোহালক্কড়ও লুট করে নিয়ে যায়। যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। সেখানে থাকা বৈদ্যুতিক মোটর ও বিভিন্ন পার্টসও নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
ভুক্তভোগীর অভিযোগ, শ্যামপুরে থাকা তার দোতলা বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। তার আরেকটি ৯ তলা ভবন ও জুতার কারখানাও জ্বালিয়ে দিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। এতে বৈদ্যুতিক সাব স্টেশন পুড়ে যায়। অফিসে থাকা ৯টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (এসি), ২০টি কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল, খাট সবই খুলে নিয়ে গেছে।
এই ভুক্তভোগীর অভিযোগ, ব্যবসা, কারখানা, বাড়িঘর সব হারিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব। দুর্বৃত্তরা শুধু তাকে পথেই বসাননি,তিনিসহ তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলাও করেছে। সব হারিয়ে গ্রেফতার আতঙ্কে এই ব্যবসায়ী এখন ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
আপনার মতামত লিখুন :