‘মব জাস্টিস’ বা উশৃঙ্খল জনতার হাতে বিচারের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনকে মারধর করে হত্যার ঘটনায় বিচার নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং অন্তর্র্বতী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্যাতনকারী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অতি দ্রæত আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিলে উত্তেজিত মবকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তবে শিক্ষার্থীদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মব জাস্টিস গ্রহণযোগ্য নয় এবং কোনো সমাধানও আনবে না।
তিন সমন্বয়ক ১৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া আলাদা স্ট্যাটাসে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে গত বুধবার রাতে তোফাজ্জল হোসেন নামের একজন ব্যক্তিতে মারধর করে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে বুধবার মারধর করা হয়। ওই দিন রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
দুই ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় মব জাস্টিস নিয়ে সমালোচনা চলছে। এরই মধ্যে তিন সমন্বয়ক ফেসবুকে তাঁদের স্বীকৃত পেজে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
নাহিদ ইসলাম: উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা দুঃখজনক। অতি দ্রæত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তদন্ত সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
অতীতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনার বিচারের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ এই অভ্যুত্থান ও বিগত বছরগুলোতে যারা ছাত্র-ছাত্রীদের নিপীড়ন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতি দ্রæত মামলা করতে হবে। ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’(তথ্যানুসন্ধান) কমিশন করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের উদ্যোগে নির্যাতনকারীদের তালিকা প্রণয়ন করতে হবে এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে বহিরাগতমুক্ত করতে কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক উদ্যোগ নিয়েও বক্তব্য তুলে ধরেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢালাওভাবে ‘বহিরাগত’ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, উচিতও নয়। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন যাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশে বিঘ্ন না ঘটে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিসর যাতে উন্মুক্ত থাকে এবং জনগণের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিথস্ক্রিয়ারও সুযোগ থাকে। ‘বহিরাগত’ জনগণের চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ অতি জরুরি।
সারজিস আলম: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে বলেন,মানসিক ভারসাম্যহীন হোক, চোর হোক অথবা দাগি আসামি হোক, কাউকে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার বা সাহস কোনো একজন ব্যক্তি কীভাবে পান? মব জাস্টিসের নামে নরপশুর ন্যায় নির্মমতা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ তৈরি হওয়া প্রয়োজন।
সারজিস আরও বলেন, কে কোথায় পড়ে, কী করে সেটা মুখ্য নয়। অন্যায় সব সময় অন্যায়। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে যাদের বুক একবারের জন্যও কাঁপে না, তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকতে পারে না।
হাসনাত আবদুল্লাহ: সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এ সংক্রান্ত একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘মব জাস্টিস কোনো বিচার নয়। এটি শুধু আরও সহিংসতা ও অন্যায়ের কারণ হয়। আমরা ন্যায়বিচার চাই, সহিংসতা নয়।’
পৃথক আরেকটি স্ট্যাটাসে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক দুটি ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের দ্রæত বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ‘মবলিঞ্চিং’ কোনো অবস্থাতেই কোনো সমাধান হতে পারে না, তাতে সে যেই হোক না কেন। এটা একটা সুস্পষ্ট অপরাধ। যে বা যাঁরাই এর সঙ্গে জড়িত, তাঁদের শনাক্ত করে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থী দাবি করে কেউ যেন পার পেয়ে যেতে না পারে।
হাসনাত আরও বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পুনর্বাসনের কোনো পথ যেমন উন্মুক্ত নয়, তেমনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে অপরাধে অভিযুক্ত হলে তাঁকেও শাস্তি পেতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে অনুরোধ করছি।
বিগত সময়ে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনাগুলোর বিচার দাবি করে হাসনাত আবদুল্লাহ আরও বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খুলবে। দেশজুড়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও দ্রæত খোলা হবে। শিক্ষার্থীরা কোনো হামলাকারীর সঙ্গে ক্লাস ও পরীক্ষায় বসতে পারে না। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নৃশংস হামলাকারীদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা করা হয়নি। প্রশাসনিকভাবে কোনো আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। তাই জুলাই বিপ্লবে শিক্ষার্থীদের ওপর প্রকাশ্যে হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে দ্রæত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :