রবিবার, ০৫ জানুয়ারি, ২০২৫, ২২ পৌষ ১৪৩১

নির্বাচনীজোটের ভোটে জামায়াতের সঙ্গি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন,বিএনপির কে?

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩, ২০২৫, ০৯:০৮ পিএম

নির্বাচনীজোটের ভোটে জামায়াতের সঙ্গি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন,বিএনপির কে?

জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক মেরুকরন কি হবে তা নিয়ে চলছে নানারকম রাজনৈতিক বিশ্লেষন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন,বিএনপির কে। তাহলে জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে কার সাথে কার জোট হতে পারে। রাজনীতিতে শেষ বলতে কিছু নেই আগামীতেও তাই-ই চিন্তা করা হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
নব্বইয়ে এরশাদ পতনের সময় একই সঙ্গে আন্দোলন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল দুটি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে জয়লাভ করেছিল।সরকারও গঠন করেছিল। এরপর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরও দল দুটি জোটবদ্ধভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জামায়াতের বেশকিছু নেতা ভোটে অংশ নেন বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে। দীর্ঘদিনের জোটবদ্ধতা থেকে দল দুটি আলাদা হয় ২০২২ সালে। সে সময় দুই দলের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বেশ গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল। তবে এ সম্পর্কের শীতলতা প্রকাশ্য বিরোধিতায় রূপ নিতে থাকে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের বর্তমান অবস্থাও ভিন্ন। এরমধ্যে মাঠে থাকা বিএনপি-জামায়াত বর্তমানে দল দুটির নেতারা পরস্পরের বিরোধিতা করে নানা বক্তব্য রাখছেন। অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম শিবিরের সন্মেলনে উল্লেখ করেন, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে রাজপথে সহযোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছিল জামায়াতের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সবকিছুর আগে, ব্যক্তির আগে, গোষ্ঠীর আগে, দলের আগে পুরো দেশের মানুষ। ২৪-এর অভ্যুত্থানে যেভাবে একসঙ্গে হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, এমনকি পরিকল্পনার টেবিলে শিবিরের সঙ্গে বসে কাজ করেছি, ঠিক সেভাবে দেশের স্বার্থকে সবার ওপরে রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাব।’
আবার জামায়াতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বিভিন্ন সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বা জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে একযোগে কাজ করার বিষয়ে বক্তব্য এসেছে। দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের ক্রমবর্ধমান বিরোধ এবং এর বিপরীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের বর্তমান সখ্যকে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকদের অনেকেই।
অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপি-জামায়াত ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন আয়োজনের দাবি করছে বিএনপি। অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে কোনো তাড়াহুড়ো দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া আরো কিছু বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দল দুটির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যেই একে অন্যের বিপক্ষে বক্তব্য রাখা হচ্ছে।
সর্বশেষ গতকালই মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য রুহুল কবির রিজভী। সিলেটে এক অনুষ্ঠানে জামায়াত নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘একাত্তরে আপনাদের ভূমিকা কী ছিল? আপনারা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? আপনারা কোন সেক্টর কমান্ডারের আন্ডারে যুদ্ধ করেছেন? বাংলাদেশে কেউ দেশপ্রেমী নেই, শুধু একটি রাজনৈতিক দল দেশপ্রেমী! এ ধরনের বিভ্রান্তি আপনারা তৈরি করলে মানুষ হাসবে। মানুষ হাসি ছাড়া আর কিছু দেবে না।’
রাজনৈতিক সুত্রগুলো থেকে জানা যায় বিএনপি ও জামায়াত জোটবদ্ধ হয় ১৯৯৯ সালে। এর পর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোটের অংশ হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অংশ নেয়। ওই নির্বাচনে ১৯৩টি আসন পেয়েছিল বিএনপি। আর জামায়াতে ইসলামী পায় ১৭টি আসন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে ৩৫টি আসন ছেড়ে দেয় বিএনপি। সেবার বিএনপি ৩০টি ও জামায়াত দুটি আসনে জয়ী হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দুটি দলই ভোট বয়কট করে। এর পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জামায়াতকে বিএনপি ২২টি আসন ছেড়ে দেয়। সেবার নিবন্ধন না থাকায় জামায়াত নেতারা নির্বাচন করেছিলেন ধানের শীষ প্রতীকে। সর্বশেষ গত বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দুই দলের কোনোটিই অংশ না নিলেও সে সময় তাদের মধ্যে সম্পর্কে শীতলতার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল রাজনৈতিক মহলে।
দীর্ঘদিনের জোটবদ্ধ দুটি দলের একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাওয়া সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বিশেষ কারণে নির্বাচনী মেরুকরণ হয়। সেটি তখনকার জন্য প্রযোজ্য থাকতে পারে। আগেও কিন্তু দর্শন বা নীতিনৈতিকতার দিক থেকে দুই দল এক রকম ছিল না। এটি ছিল নির্বাচনী জোট। তবে সবসময় এক রকম থাকবে এমন তো কোনো কথা নেই। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন ঘটে। রাজনীতি পরিবর্তন হয়। জনগণের ভাবনার মধ্যেও অনেক পরিবর্তন ঘটে। এতে তাদের প্রত্যাশাও বদলে যায়। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই রাজনীতি করতে হয়।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি আরো বলেন,তারা তাদের মনের কথা বলে ফেলছে, সেটিও ভালো। ফলে কাদের রাজনীতি কী সেটি বুঝতে জনগণের বাকি থাকল না। আমরা আমাদের মতো ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করেছি। সবচেয়ে বেশি নেতাকর্মী গুম-খুন হয়েছে বা জেলে গেছে বিএনপির। ৬০ লাখের ওপর বিএনপির নেতাকর্মী মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছে। সুতরাং আমাদের সঙ্গে আর কারো তুলনার দরকার নেই। পুরোটা সময় শেখ হাসিনার পতনের জন্য আমরা আন্দোলন করেছি। কাউকে সহযোগিতা করার জন্য আমরা আন্দোলন করিনি। শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র, মুক্তবাজার অর্থনীতি, বাংলাদেশের মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বসহ দলের অন্যান্য আদর্শ নিয়েই বিএনপির রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে। কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে আমাদের আলাদা কোনো ভাবনা নেই।’
৫ আগস্টের পর থেকেই ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘনিষ্ঠতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সম্প্রতি তাদের মধ্যকার সম্পর্কটি আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলতে শোনা যাচ্ছে।
অতীতে জামায়াতের সহযোগিতা ছাড়া বিএনপির জন্য সরকার গঠন সম্ভব ছিল না বলে মনে করছেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ। তার ভাষ্যমতে, ‘অতীতে বিএনপি যখন সরকার গঠন করেছে তখন জামায়াতের নিঃশর্ত সমর্থন ছিল। জামায়াতের সমর্থন ছাড়া সরকার গঠন করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এর আগে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৪৬ জনের বেশি নেতাকে হত্যা করেছিল ছাত্রদল। এগুলো ইতিহাস। আমরা সে ইতিহাসের কোনো পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। এখন জাতির সবচেয়ে বেশি দাবি ঐক্য। এ ঐক্যের পরিপন্থী কথা যারা বলেন, তারা কোন উদ্দেশ্যে বলছেন তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের জনগণের কাছেও পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ও ভারতের বিরুদ্ধে। জামায়াতে ইসলামীও তাই। সুতরাং এর বাইরে কারো কথা মানুষ গ্রহণ করবে না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন,এর কারণ হলো ইসলামী ছাত্রশিবির ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। শিবিরের ভূমিকা ব্যতীত ছাত্রসমাজের মধ্যে ঐক্য আসত না, আন্দোলন হতো না। এটি তারা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। এটিকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত।’
দেশের রাজনীতিতে দ্বিমেরুকরণ ঘটেছে কিনা এখনই তা চূড়ান্তভাবে বলা উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন,এখন উত্তরণ বা ক্রান্তির সময় চলছে। অনেক ভাংচুর চলছে। এখনো সব ফ্যাক্টর দৃশ্যমান নয়। এর সঙ্গে ছাত্রদের উত্থান এবং তাদের বক্তব্য থেকে তাদের চাওয়ার বিষয়ে অনেক দ্বিধা তৈরি করছে। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ নিয়ে চূড়ান্ত কোনো কথা এখনই বলা যায় না। যদিও দৃশ্যত মেরুকরণ ঘটেছে বলে মনে হয়। নির্বাচনের ভোটের পরই তা বোঝা যাবে। সংসদীয় গণতন্ত্রের ভোটের হার মেরুকরণে প্রভাব ফেলে। জামায়াতের ভোট হলো ক্যাডারভিত্তিক। তাই এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আর আওয়ামী লীগের প্রতি বীতশ্রদ্ধ অনেকেই বিএনপিকে ভোট দেবে। সুতরাং তাদের ভোট বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা সেটিও এখন অনিশ্চিত। তবে বিএনপি যদি ২০০ বা তার বেশি আসনে জয়ী হয় তাহলে জামায়াতের অবস্থানটি কেমন থাকবে; সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। জামায়াত মাঠে শক্তি দেখাবে। এটিকে উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু চূড়ান্ত ভাবে বলার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক কমিটিতে ছাত্রশিবিরের জনাদুয়েক নেতা তো রয়েছে। ছাত্রদের মধ্যেও তাদের প্রভাব আছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তাদের একটা সখ্য বোঝা যাচ্ছে। এসব বিষয় থেকে ছাত্ররা জামায়াতের পকেটে ঢুকে গেছে এমনটি বলা না গেলেও নিশ্চিতভাবেই তারা জামায়াতের প্রভাব উপেক্ষা করতে পারছে না।সুত্র-বণিকবার্তা

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!