রংপুরে আট দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সমাবেশ করেছে ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’। সমাবেশে গত পাঁচ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর দেশব্যাপী মন্দির,হিন্দু বাড়িঘরে হামলা, শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে সনাতনীদের রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে বিভক্ত ও ইসকনকে জঙ্গি বানানোর পায়তারা প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
শুক্রবার ২২ নভেম্বর দুপুরের আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয় নগরীর মাহীগঞ্জ কলেজ মাঠ। সমাবেশে রংপুর বিভাগের আট জেলার বিভিন্ন উপজেলার সনাতনীরা দলে দলে মিছিল নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।
এর আগে রংপুর নগরের জিলা স্কুল মাঠে বিভাগীয় সমাবেশ হওয়ার কথা থাকলেও অনুমতি পায়নি সংগঠনটি। পরে শহর থেকে দূরে মাহীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়।
সনাতন জাগরণ মঞ্চ রংপুরের সমন্বয়ক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন,তারা জিলা স্কুল মাঠে সমাবেশ করতে জেলা প্রশাসনের কাছে অনুমতি চান। কিন্তু তাদের জিলা স্কুল মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। রংপুর শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে মাহীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে সমাবেশ করতে বলা হয়েছে।
দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের অভিযোগ,প্রশাসন চাচ্ছে না তাদের কর্মসূচিটি সফল হোক। তাই পূর্বনির্ধারিত ভেন্যু না দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। অথচ কয়েক দিন আগে একই মাঠে একটি রাজনৈতিক দল সমাবেশ করেছিল। তবে জেলা প্রশাসনের সূত্র বলছে, শহরে যানজট হওয়ায় আশঙ্কায় ভেন্যু পরিবর্তন করা হয়েছে।
গত পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও মঠ-মন্দিরে হামলার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে ‘সনাতন জাগরণ মঞ্চ’। ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ এবং বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোট মিলে ‘সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’ আত্মপ্রকাশ করে। এই জোটের ব্যানারে রংপুর বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদসহ সব শহীদকে স্মরণ করে বলেন,রক্তচক্ষু, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বাধা উপেক্ষা করে যারা সমাবেশে উপস্থিত হয়েছে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
তিনি বলেন, সৈয়দপুর, জলঢাকা, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম থেকে আসা বহু বাস আটকে রাখা ও হামলা করা হয়েছে। কয়েকজন আহত হয়েছে। রংপুরের পুলিশ কমিশনারের তত্ত্বাবধানে কয়েকজনকে রংপুর মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন,রংপুর পুলিশ সুপারের নির্দেশে আমাদের হোটেল ছাড়তেও বাধ্য করা হয়েছে।
এদিকে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কুড়িগ্রাম-রংপুর মহাসড়কের কাউনিয়া পয়েন্টে সমাবেশে আসা বাসে একদল লোক হামলা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ৩০ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। তাদের কাউনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
চিন্ময় বলেন,পাঁচ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তনের পরে যেখানেই আন্দোলন হয়েছে, সেখানেই স্বীকৃতি মিলেছে,পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তিন মাস সময় পর হলেও আমাদের কোনো সমাধান হয়নি। এখনও অনেক জায়গায় লুটপাট,ভাঙচুর, চাঁদাবাজি,চাকরিচ্যুতি চলছে। রংপুরে গত সপ্তাহে প্রশাসনের উপস্থিতি চাকরিচ্যুতি হয়েছে। এই অবস্থা চলার কারণ, এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের একটি অংশ, রাজনৈতিক একটি অংশ এবং তারা সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশ থেকে সনাতনীদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলাচ্ছে। আমরা এই ভূমির ভূমিপুত্র। কোনো অবস্থাতেই আমাদের এখান থেকে ছুড়ে ফেলা যাবে না। আমরা মোঘল নই, আমরা ওলোন্দাজ নাই, আমরা ফরাসি নই, আমরা ব্রিটিশ নই, আমরা উড়ে আসিনি। আমরা এই বঙ্গ যিনি প্রহ্লাদ মহারাজের পৌত্র, বলি মহারাজের পুত্র, সেই বঙ্গ মহারাজ বঙ্গের নাম অনুসারে যে বঙ্গ ভূমি আমরা তার উত্তরাধিকার। আমাদের এখানে প্রথম অধিকার রয়েছে। আমাদের অধিকারকে অস্বীকার করার কোনো প্রচেষ্টা সনাতনীরা আর মেনে নেবে না।
তিনি বলেন,বহু নিপীড়ন,নির্যাতন হয়েছে।দলীয় তকমায় সনাতনীদের বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। কিন্তু এখন ঐক্যের সুবাতাস বয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের কেউ বিভক্ত করতে চাইলে তাকে আমরা ছুড়ে ফেলবো। কোনো অবস্থায় আমরা বিভক্ত হবো না।চিন্ময় শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন,এই দেশ উপনিবেশিক শক্তির লীলাভূমি হতে পারে। কোনো সরকার, রাজনৈতিক দল স্থায়ী ক্ষমতা উপভোগ করতে পারবে না। বিদেশি শক্তি এখন থেকেই বাংলাদেশের জায়গায় থাবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা জীবিত থাকতে এক ইঞ্চি জমি নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেবো না। তাই বলতে চাই, আমার মা আমাদের কাছে যেমন, এই মাতৃভূমিও আমার মায়ের মতো। আমরা এখানে জন্মেছি, এখানেই থাকবো। কোথাও যাবো না।
আজকে ঐক্যবদ্ধ গণতন্ত্র, সমতা, সাম্য, মৌলিক অধিকারের দাবিতে আমরা সংঘবদ্ধ হয়েছি। যে জাতি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে, জাতীয় সংগীত গেয়ে সাম্যের কথা বলে, যে কোনো কর্মসূচি শুরু করে সেই জাতিকে অতিশয় দুর্ভাগ্যের বিষয় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় আমাদের আসামি করা হচ্ছে। অথচ যারা এই জাতীয় পতাকায় যারা চাঁদ তারা লাগিয়েছে, জাতীয় পতাকা ছুড়ে ফেলেছে, জাতীয় পতাকা পদদলিত করেছে, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে চেয়েছে এই সরকার,প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপও গ্রহণ করেনি। এই অবস্থা প্রমাণ করে সরকার পক্ষপাত দুষ্ট। এই সরকার মৌলিক গণতন্ত্রে সাম্যে যদি বিশ্বাস করে তাহলে সবার প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন করুন, যোগ করেন চিন্ময়।
রংপুর জেলা প্রশাসকের বরাত দিয়ে তিনি বলেন,ডিসি বলেছেন রংপুরের লোক না হলে নাকি কথা বলা যাবে না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, আপনি আমার টাকায়, আমার ট্যাক্সের টাকায় চাকরি করেন। এই ধৃষ্টতার জন্য ডিসিকে প্রত্যাহারের দাবি জানান চিন্ময়।
আট দফা দাবিগুলো হলো-সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের জন্য দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্থদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন। অবিলম্বে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন।সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন। হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ‘হিন্দু ফাউন্ডেশনে’ উন্নীত করাসহ বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মীয় ট্রাস্টকেও ফাউন্ডেশনে রূপান্তর।‘দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন এবং ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইন’র যথাযথ বাস্তবায়ন। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ ও প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনা কক্ষ বরাদ্দ করা। ‘সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাবোর্ড’ আধুনিকায়ন।দুর্গাপূজায় ৫ দিন ছুটিসহ প্রতিটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে প্রয়োজনীয় ছুটির ব্যবস্থা করা। চিন্ময়ের আরও অভিযোগ,আজকে ইসকনকে জঙ্গি বলা হচ্ছে। কিন্তু আজকে আমাদের সমাবেশে আগত ভক্তদের ওপর হামলা করে প্রমাণ করা হয়েছে কারা জঙ্গি। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এ দেশে কেউ সংখ্যালঘু না, সবাই বাংলাদেশি। সেই কথার প্রেক্ষিতে বলতে চাই, সনাতনীরা কোনো নির্দিষ্ট দলের কিংবা রাজনৈতিক দলের সমর্থন করে না। আমাদের ন্যায় অধিকার যারা নিশ্চিত করবে আমরা তাদের ভোট দেবো। আমরা রাষ্ট্রবিনির্মাণে সহযোগিতা করতে চাই। আমরা উপদেষ্টা হতে চাই না। আমরা ক্ষমতা চাই না। রাষ্ট্রবিনির্মাণে সহযোগী হতে চাই। সংস্কারে আমাদের সঙ্গে রাখুন। আমাদের বাদ দিয়ে কোনো সংস্কার হলে তা মেনে নেবো না।এসময় সনাতনীদের ওপর হামলা ও নির্যাতন বন্ধ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশে থাকার অনুরোধ জানানো হয়।
সমাবেশে অন্যদের মধ্যে সংগঠনটির সহ-মুখপাত্র গোপীনাথ ব্রহ্মচারী, রংপুর বিভাগের সমন্বয়ক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, মানিক চৌধুরী, আলোক ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রায় লক্ষাধিক নেতাকর্মী সমাবেশে অংশ নেয়।
আপনার মতামত লিখুন :