শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর দুজনকে পিটিয়ে হত্যা, তীব্র ক্ষোভ

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪, ১০:২৩ এএম

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর দুজনকে পিটিয়ে হত্যা, তীব্র ক্ষোভ

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দিনে দুজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বইছে সারা দেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম (এফ এইচ) হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্ঝল নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে একদল শিক্ষার্থী। আর জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে কয়েক দফা মারধর করে হত্যা করা হয়। এ দুটি ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকান্ডের ঘটনায় ১৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার শাহবাগ থানায় মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছয় শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের একজন ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগী নেতা, অন্যদের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক ও ছাত্রদলের চার নেতা-কর্মীসহ কিছু শিক্ষার্থী জড়িত বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আহসান লাবিবকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে এবং ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা পঙ্গু আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় ‘মব জাস্টিস’ (উচ্ছৃঙ্খল জনগোষ্ঠীর বিচার) চলতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানানো হলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকান্ড: শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বুধবার দুপুরে এফ এইচ হলের মাঠে শিক্ষার্থীদের খেলা চলাকালে কয়েকজনের মুঠোফোন ও মানিব্যাগ চুরি হয়। পরে রাত আটটার দিকে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবক মাঠে ঢুকলে তাঁকে চোর সন্দেহে ধরে হলের অতিথিকক্ষে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে শুরু হয় মারধর। পরে ওই যুবককে হলের ক্যানটিনে রাতের খাবার খাওয়ানো হয়। এরপর আবার আরেকটি অতিথিকক্ষে নিয়ে পেটানো হয়। মারধরের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
মারধরের খবর পেয়ে হলের আবাসিক শিক্ষকেরা রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে গেলেও তোফাজ্জলকে উদ্ধার করতে পারেননি। গুরুতর আহত অবস্থায় রাত ১২টার পর তোফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান কয়েকজন শিক্ষার্থী। রাত পৌনে একটার দিকে ওই যুবককে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে ছয় শিক্ষার্থীকে এফ এইচ হল থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁরা হলেন জালাল মিয়া, মোহাম্মদ সুমন, মোত্তাকিন সাকিন, আল হোসাইন সাজ্জাদ, আহসানউল্লাহ ও ওয়াজিবুল আলম। তাঁরা সবাই এফ এইচ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। জালাল মিয়া একসময় হল শাখা ছাত্রলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপসম্পাদক ছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে তিনি ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সক্রিয় হন।
ঘটনা তদন্তে এফ এইচ হলের আবাসিক শিক্ষক আলমগীর কবিরকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের কমিটি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ইতিমধ্যে এফ এইচ হলের চার শিক্ষার্থীকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালে প্রতিবেদন দেবে।
জানা গেছে, নিহত তোফাজ্জলের (৩২) গ্রামের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নে। তাঁর আসল নাম মাসুদ কামাল। একসময় কাঁঠালতলী ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। তোফাজ্জলের ভাবি শরীফা আক্তার প্রথম আলোর পাথরঘাটা প্রতিনিধিকে বলেন, বাবা, মা ও একমাত্র বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।
বিক্ষোভ, প্রতিবাদ: তোফাজ্জলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বুধবার রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ করেন কিছু শিক্ষার্থী। সকালে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিলের পর এফ এইচ হলের প্রাধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনেও বিক্ষোভ করেন ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী। বিকেলের দিকে ‘গণতন্ত্রকামী শিক্ষার্থীবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’–এর ব্যানারে ক্যাম্পাসে আরেকটি বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়। এসব কর্মসূচি থেকে যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে ‘মব জাস্টিস’ আখ্যা দিয়ে বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকান্ডের নিন্দা-প্রতিবাদ ও বিচার দাবি করা হয়।
জাহাঙ্গীরনগরে হত্যা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটুনিতে নিহত শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা ফটকের একটি সেলুনের সামনে পরিচিত একজনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন শামীম। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী সেখানে শামীমকে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা তাঁকে টেনে ক্যাম্পাসের ভেতরে নিয়ে আরও কয়েকজন মিলে মারধর করেন।
সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম এবং নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা শামীমকে প্রক্টর কার্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার করিডরে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা–কর্মী সেখানে গিয়ে শামীমকে আবার মারধর করেন।
প্রক্টরিয়াল টিম তাঁকে উদ্ধার করে নিরাপত্তা শাখার করিডরে রেখে ফটকে তালা দেয়। এরপর ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা–কর্মী তালা ভেঙে শামীমকে বেধড়ক মারধর করেন।
গত বুধবার রাত সোয়া আটটার দিকে প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা গুরুতর আহত শামীমকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করলে পুলিশ রাত নয়টার দিকে সাভারের গণ স্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক শামীমকে মৃত ঘোষণা করেন।
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক(তদন্ত)কামাল হোসেন বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে শামীম মোল্লার মরদেহ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ অভিযোগ করলে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, গত ১৫ জুলাই রাতে ছাত্র আন্দোলনের সময় শামীমসহ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। এই অভিযোগে বুধবার তাঁকে মারধর করা হয়। শামীমের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও তুচ্ছ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগও ছিল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়প্রশাসন জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শামীম মোল্লার মৃত্যুর ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী অভিযুক্ত আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীরা হলেন সরকার ও রাজনীতি বিভাগের মোহাম্মদ রাজন মিয়া, একই বিভ াগের রাজু আহমেদ, ইংরেজি বিভাগের হামিদুল্লাহ সালমান,একই বিভাগের মাহমুদুল হাসান রায়হান, ইতিহাস বিভাগের জুবায়ের আহমেদ,ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের আতিকুজ্জামান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সোহাগ মিয়া এবং বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আহসান লাবিব।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আহসান লাবিব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাহাঙ্গীরনগর শাখার সমন্বয়ক। রাজু, রাজন ও হামিদুল্লাহ ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ ভুঁইয়াও এ ঘটনায় জড়িত বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সুষ্ঠু তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত লাবিবের অব্যাহতি বহাল থাকবে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ কামরুল আহসান সন্ধ্যায় বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে, তা ন্যক্কারজনক। একটি তদন্ত কমিটি করার প্রস্তুতি শেষের দিকে। তাৎক্ষণিকভাবে উপাচার্যের যতটুকু এখতিয়ার, তা করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের সাময়িক বহিষ্কার এবং তদন্ত সাপেক্ষে পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দিনভর বিক্ষোভ:শামীম মোল্লার মৃত্যুর ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড উল্লেখ করে দিনভর বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বুধবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে বিক্ষোভ করেন একদল শিক্ষার্থী। ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পরে দুপুরে শিক্ষার্থীদের আরেকটি দলও একই দাবিতে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেন। ঘটনার বিচার নিশ্চিতসহ চার দফা দাবি জানিয়ে বিবৃতি দেয় প্রগতিশীল শিক্ষকদের একটি দল।

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!