দেশের বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ছিনিমিনি খেলা অব্যাহত আছে বছরজুড়েই। কখনও অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি, আবার কখনও বাজার থেকে পণ্য উধাও। এভাবেই সিন্ডিকেট করে ভোক্তাদের পকেট কেটেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতিও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এতে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেয়েছেন ভোক্তারা। সংসারের বাজার করতে গিয়ে বাজারের চিত্র চলতি বছরের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী খাদ্য মূল্যস্ফীতি বছরের শেষ ভাগে এসেও বাড়ছে।
গত এপ্রিলে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায় দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি। জুলাইতে সেটি পৌঁছে যায় ১৪ শতাংশে। এর কিছুটা বেড়ে-কমে সেটি এখন অবস্থান করছে ১৩.৮০ শতাংশে।
মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ নিলেও কাজে আসছে না কোনোটিই। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বলেছেন, উদ্যোগ নেয়ার পর ১২ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ফেলার রেকর্ড বিশ্বের কোনো দেশেই নেই। আমরা কেবল ৩ মাস হলো শুরু করেছি। মূল্যস্ফীতি কমাতে আরও ৮ মাস অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে কাঁচা মরিচ, চিনি, আলু, চাল, গরু ও মুরগির মাংস, তেল, ডিম, ফল থেকে শুরু করে হালের পেঁয়াজ, বছরজুড়ে এসব পণ্য ছিল ব্যাপক আলোচনায়। এসব পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার শুল্ক হ্রাস করে বিদেশ থেকে আমদানির পথেও হেঁটেছে।
লাগামছাড়া শাক-সবজির দাম-জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরের বন্যা ও অতিবৃষ্টির প্রভাবে দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে শাক-সবজির দাম।অক্টোবর মাসে প্রায় সব সবজির দাম উঠে যায় ১০০ টাকার ওপরে। নভেম্বরের শুরুতে সেটি কিছুটা কমে আসলেও শেষদিকে ফের বাড়ছে দাম। শীতের সবজিতেও নাগালে আসছে না বাজার। নানা অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে দাম।
আলুতে সিন্ডিকেট-চলতি বছরের শুরু থেকে লাগামহীন আলু বাজার। বছরের মাঝামাঝি দাম কিছুটা কমলেও অক্টোবরের শেষ দিকে এসে ফের ঊর্ধ্বমুখী আলুর বাজার। দাম নিয়ন্ত্রণে গত ৫ সেপ্টেম্বর আলু আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করার পাশাপাশি ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।তবে বাজারে পড়েনি এর কোনো প্রভাবই। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে বাজারে নতুন আলু উঠতে শুরু করলেও তার প্রভাব পড়েনি দামে। নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ১০০-১২০ টাকা কেজিতে। প্রতি কেজি পুরোনো আলু বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়। আর বীজ থেকে কেটে রাখা আলু বিক্রি হয়েছে ৪৮ থেকে ৫৫ টাকায়।
আগামী বছর যে আলুর দাম নাগালে আসবে নেই তারও কোনো ইঙ্গীত। উল্টো বাড়তে পারে দাম। কারণ আলু উৎপাদনের অন্যতম শীর্ষ জেলা মুন্সীগঞ্জে আলু রোপণের মৌসুম শুরু হলেও বীজ আলুর চড়া দামে নাকাল কৃষকরা। একই অবস্থা অন্যান্য জেলায়ও।
মুন্সীগঞ্জে হল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত বীজের ৫০ কেজির প্রতি বাক্স আলু বিক্রি হচ্ছে ২৫ হাজার টাকার ওপরে। গত বছর একই পরিমাণ বীজ আলুর দাম ছিল মাত্র ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। এ বছর প্রথমে ১১ হাজার টাকা দরে বিক্রি শুরু করলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণের বেশি। পাশাপাশি চড়া সারের দামও। ফলে আগামী বছর আলুর দাম যে খুব একটা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে না সেটি আন্দাজ করা যাচ্ছে।
চোখে জল এনেছে পেঁয়াজ-পুরো বছর জুড়েই ওঠানামার মধ্যে ছিল পেঁয়াজের বাজার। মূলত ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করায় দামে প্রভাব পড়ে। তবে গত ৪ মে পেঁয়াজ রফতানির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় দেশটি। এতে দাম কিছুটা কমে আসে।
জুন-জুলাইতে এসে ফের অস্থির হতে থাকে বাজার। এসময় দাম ছাড়িয়ে যায় ১২০ টাকা। বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ৫ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ আমদানিতে বিদ্যমান ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করে এনবিআর। তবে কমার বদলে মৌসুম শেষের অজুহাতে উল্টো বেড়ে যায় দাম। খুচরায় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১৫০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১২০ টাকায়।
এ পরিস্থিতিতে গত ৬ নভেম্বর পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক-কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে এনবিআর। এ সুবিধা ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বহাল থাকবে। এতে নভেম্বরে শেষ দিকে কমতে থাকে দাম। কমলেও বিক্রি হতে দেখায় যায় ১০০ টাকার ওপরে। সে সময় খুচরায় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১১৫-১২০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৯৫-১০০ টাকায়।
বিক্রেতারা জানান,পেঁয়াজের কালি ওঠায় এবং আমদানি করা পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ায় দাম কমেছে পণ্যটির। তবে নতুন দেশি মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসার আগ পর্যন্ত দাম ১০০ টাকার নিচে নামার সম্ভাবনা কম।
তেল নিয়ে তেলবাজি-বছরের শুরুতে সেভাবে না বাড়লেও অস্থির ছিল দেশের ভোজ্যতেলের বাজার। রোজায় আরও বাড়ে সে অস্থিরতা। এরপর তেলের বাজারে দেখা যায় কিছুটা স্থিতিশীলতা।
নভেম্বরের শুরুতে এসে ফের অস্থিরতা শুরু হয় তেলের বাজারে। বোতলজাত তেলের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা যায় খোলা ভোজ্যতেল। এসময় খোলা সয়াবিন তেল দাম বেড়ে প্রতি লিটার ১৭৫-১৮০ টাকা ও খোলা পাম তেল বিক্রি হয় ১৮০ টাকায়। তবে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত অক্টোবরে পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পাম তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে আরোপিত ১৫ শতাংশ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরোপিত ৫ শতাংশ মূসক অব্যাহতি দিয়েছিল এনবিআর। এছাড়া অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত পাম তেল ও পরিশোধিত পাম তেলসহ অন্যান্য পরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ের মূসক ১৫ শতাংশের পরিবর্তে পরিবর্তে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এতেও বাজার নিয়ন্ত্রণে না এলে গত ১৯ নভেম্বর ভোজ্যতেলের ওপর প্রযোজ্য আমদানি পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এতে বাজারে সামান্য কমে ভোজ্যতেলের দাম। তবে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে বাজার থেকে উধাও হতে শুরু করেছে ১ ও ২ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল। ফলে আসন্ন রমজানে তেলে বাজার কেমন হবে, সেটি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
কাঁচা মরিচের ঝাল-গত বছরের মতো চলতি বছরও বাজারে সবচেয়ে বেশ উত্তাপ ছড়িয়েছে কাঁচা মরিচ। কোরবানির ঈদের ঠিক আগমুহূর্তে দেশের বাজারে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় মরিচের দাম। দেশের কোথাও কোথাও প্রতি কেজি মরিচ বিক্রি হতে দেখা যায় ৪০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত। এরপর নভেম্বর পর্যন্ত দফায় দফায় ওঠানামা করে দাম। ব্যবসায়ীরা জানান,অতিরিক্ত গরম,বৃষ্টি ও বন্যার কারণে দামে তারতম্য ঘটে মরিচের।তবে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে দাম পড়ে যায় কাঁচা মরিচের। বিক্রি হতে দেখা যায় ৮০-১০০ টাকার মধ্যে।
মসলার ঝাঁজ-সারাবছর তেমন একটা না বাড়লেও কোরবানির ঈদে মাত্রাতিরিক্ত বাড়ে মসলার দাম। সে সময় প্রতি কেজি এলাচের দাম ছাড়িয়ে যায় ৪ হাজার টাকা। এছাড়া অন্যান্য মসলার দামও ছিল বেশ চড়া। ব্যবসায়ীরা সে সময় জানান, ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় মসলার বাজার অস্থির হয়ে উঠেছিল।
চিনি নিয়ে ছিনিমিনি-সারা বছরজুড়েই অস্থির ছিল দেশের চিনির বাজার। চিনি নিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে এক প্রকার ছিনিমিনিই খেলেছেন মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এতে চিনির দাম চলে গেছে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নাগালের বাইরে।এ পরিস্থিতিতে গত ৮ অক্টোবর পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করেছে এনবিআর।
নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫০ শতাংশ হ্রাস করা সত্ত্বেও বাজারে পরিশোধিত চিনির সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এক সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় পরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক প্রতি মেট্রিক টন ৬ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৪ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। এতে বাজারে কমতে শুরু করেছে দাম। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ১২৫-১৩০ টাকায়।
গরুতে সিন্ডিকেট-মাংস বিক্রেতা খলিল কান্ডে বছরের শুরু থেকে আলোচনা ছিল গরুর মাংস। খলিলের উদ্যোগে মাংসের দাম নেমে এসেছিল ৬০০-৬৫০ টাকায়। তবে শবে বরাতের আগে হঠাৎই বাজারে বেড়ে যায় গরর মাংসের দাম। সে সময় প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয় ৮০০ টাকায়। আর হাড়-চর্বি ছাড়া মাংস বিক্রি হয় ১ হাজার টাকায়।এতে রোজার প্রথম দিন থেকে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৫৯৫ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দেন খলিল। ফলে তার দোকান ‘খলিল গোস্ত বিতানে’ ক্রেতার ঢল নামে। এরপর ১০ রোজা না যেতেই প্রতি কেজি মাংসের দাম ১০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই মাংস ব্যবসায়ী। কিন্তু সেখান থেকে সরে এসে আবারও ৫৯৫ টাকায় মাংস বিক্রির ঘোষণা দেন খলিল।
কিন্তু হঠাৎই মাংস ব্যবসায় ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন খলিল। তিনি বলেন, আমি আর মাংস ব্যবসাই করবো না। কথা দিচ্ছি, আগামী ২০ রমজানের পর আর খলিল মাংস বিতান থাকবে না। জীবনেও আর মাংস ব্যবসা করবো না।’
এরপর কিছুদিন বাজার স্থিতিশীল থাকলেও কোরবানির ঈদের আগে ফের বাড়তে শুরু করে দাম। সে সময় প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হতে দেখা যায় ৯০০ টাকায়। তবে বর্তমানে দাম কমে প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকায়।
চোখ রাঙিয়েছে মুরগি-বর্তমানে মুরগির বাজার নিম্নমুখী থাকলেও বছরজুড়ে এ বাজার ছিল চরম অস্থিতিশীল। প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৬০ টাকা কেজিতে। পাশাপাশি বাড়তি দামে বিক্রি হয় সোনালি, দেশি ও লাল লেয়ার মুরগিও।
গত এপ্রিল-মে মাসে তীব্র গরম ও সরবরাহ ঘাটতির অজুহাতে প্রতি কেজি ব্রয়লার ২৬০ টাকা, দেশি মুরগি ৭০০ টাকা, সোনালি মুরগি ৪০০ টাকা, লাল লেয়ার ৩৪০ টাকা ও সাদা লেয়ার বিক্রি হয়েছে ২৯০ টাকা পর্যন্ত।
এরপর দাম কমে বাজার কিছুটা স্থিতিশীলই ছিল। তবে আগস্টে বন্যায় খামার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় ফের দাম বাড়ে মুরগির। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার দাম কমতে শুরু করে। তবে গত সেপ্টেম্বরে সোনালি ও ব্রয়লার মুরগির দাম বেঁধে দেয় প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। যা বাজারের দরের চেয়ে বেশি। এই সুযোগে ফের লাফিয়ে লাফিয়ে মুরগির দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। ফলে সোনালি মুরগির কেজি ৩২০ টাকা ও ব্রয়লারের কেজি গিয়ে ঠেকে ২১০ টাকায়।
নভেম্বরের শেষ দিকে এসে আবার কমতে শুরু করে মুরগির দাম। এসময় প্রতিকেজি ব্রয়লার ১৭৫-১৯০ টাকা, সোনালি ২৯০-৩০০ টাকা, দেশি মুরগি ৫৫০-৬০০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৩০ টাকা ও লাল লেয়ার বিক্রি হতে দেখা গেছে ২৮০ টাকায়।
তবে ইতোমধ্যে বিয়ের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে; দাম কতদিন কম থাকবে বলা যাচ্ছে না। চাহিদা বাড়লে দামও বেড়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ডিমের ডিগবাজি-মুরগির সঙ্গে চলতি বছর অস্থির হয়ে ওঠে মুরগির ডিমের বাজার। প্রতি ডজন লাল ডিমের ১৮০-১৯০ টাকা ও প্রতি ডজন সাদা ডিমের দাম উঠে যায় ১৭৫ টাকা পর্যন্ত।
আগস্টে বন্যায় খামার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় ডিমের দাম বাড়তে শুরু করে। এর ফলে গত সেপ্টেম্বরে ডিমের উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বেঁধে দেয় প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। এতে দাম না কমলে ভারত থেকে ডিম আমদানির পথে হাটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কয়েক দফায় ভারত থেকে ডিম আমদানি করা হয়।
পাশাপাশি কমানো হয় ডিমের আমদানি শুল্কও। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় এনবিআর। এর পাশাপাশি অভিযান, সভা ও ডিম আমদানিসহ নানা নাটকীয়তার পর স্বস্তি ফিরেছে ডিমের বাজারে। বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদক পর্যায় থেকে কম দামে ডিম কিনতে পারলে পাইকারি ও খুচরা বাজারেও নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব হবে। বর্তমানে প্রতি ডজন লাল ডিম খুচরা পর্যায়ে ১৪৪-১৪৫ টাকা ও সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪৪ টাকা।
চালে চালবাজি-বছরের শুরুতেই হঠাৎ নির্বাচনের অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। ফেব্রæয়ারি-মার্চে দাম বাড়ে আরেক দফা। তবে অন্যান্য বছর রোজায় চালের দাম না বাড়লেও এবছর সরবরাহ সংকটের দোহাই দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেন মিল-মালিকরা। যার প্রভাব পড়ে খুচরা বাজারেও।
এরপর বাজার অভিযান ও চাল আমদানির অনুমতি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে তৎকালীন খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের কোনো নির্দেশনায় মানেন না ব্যবসায়ীরা। উল্টো বাড়িয়ে দেন দাম।
অবশেষে দাম নিয়ন্ত্রণে গত ২০ অক্টোবর চালের ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, বিদ্যমান রেগুলেটরি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছিল এনবিআর। এতে দাম না কমলে গত ৩১ অক্টোবর চাল আমদানিতে শুল্ক পুরোপুরি তুলে নিয়েছে সরকার।
বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট ৭০-৭২ টাকা, আটাইশ ৬০-৬২ টাকা,নাজিরশাইল ৭৬-৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর কারওয়ানবাজারের বরিশাল রাইছ এজেন্সির বিক্রেতা জানান, নতুন করে আর না বাড়লেও চালের দাম কমেনি। বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট ৭০-৭২ টাকা, আটাইশ ৬০-৬২ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬-৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে নতুন পাইজাম ও আটাশ চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে। সামনে দাম কমতে পারে।
ফলের বাজারেও অস্থিরতা-চলতি বছর রোজায় চাহিদাকে পুঁজি করে ফলের বাজারে দেখা দেয় অস্থিরতা। খেজুর তরমুজসহ দেশি ফলের দাম বেড়ে যায় লাগামহীনভাবে। প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হতে দেখা যায় ১০০ টাকায়।এরপর অতিরিক্ত দামের কারণে মানুষ তরমুজ কেনা বাদ দিয়ে দাম নেমে আসে ৪০ টাকায়। তবে বাড়তি দামেই বিক্রি হতে দেখা যায় অন্যান্য ফল।
আর প্রতিবছরই রমজানে আকাশচুম্বী থাকে খেজুরের দাম। এবছর তার ব্যতিক্রম ছিল না। খেজুর বিক্রি হয়েছে চড়া দামে। তবে আসন্ন রমজানে খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে খেজুর আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম কর কমানোর পাশাপাশি আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
২৫ শতাংশ হতে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ মোট করভার ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ হতে কমিয়ে ৩৮ দশমিক ৭০ শতাংশ করা হয়েছে। এই সুবিধা ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
বাজারের যখন এই অবস্থা তখন আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ সাধারণ ভোক্তারা। হিমশিম খেতে হচ্ছে সংসার চালাতে। মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট ভোক্তারা জানান,প্রতিদিনই বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। তার বিপরীতে কমছে না; কমলেও খুবই নগণ্য। শুধু আমদানি শুল্ক হ্রাস বা বিদেশ থেকে পণ্য আনলেই হবে না, দাম নিয়ন্ত্রণে করতে কঠোর বাজার মনিটরিংও দরকার। না হলে সারা বছরই পকেট কাটবে ভোক্তার। আর আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাবেন মধ্যবিত্তরা।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে কাজে আসবে না কোনো উদ্যোগই। সম্প্রতি সময় সংবাদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্যাব সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, চলতি বছর বাজারে ঊর্ধ্বমুখী ছিল প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম। সরকার পতনের পর মাঝে এক সপ্তাহ দাম কমলেও এখন আবার সেটি চড়া। কারণ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা পোশাক বদলেছে, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি। তারা আগের মতোই কারসাজি করে যাচ্ছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত মনিটরিং করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, না হলে সুফল মিলবে না। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
কেমন যাবে ২০২৫ সালের নিত্যপণ্যের বাজার?-অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ২০২৪ সালে ঊর্ধ্বমুখী থাকা নিত্যপণ্যের বাজার ২০২৫ সালেও গরম থাকতে পারে বলে মনে করছেন ভোক্তা ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা। ভোক্তারা জানান, বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে কোনোভাবেই কমানো যাবে না নিত্যপণ্যের দাম।
আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার আসায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এদের শক্ত হাতে দমন করতে না পারলে ২০২৫ সালেও অস্থির হবে নিত্যপণ্যের বাজার। তাই সরকারি নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজন ভোক্তাদের সচেতনতা। সচেতনায়ই সফলতা। সুত্র-সময়
আপনার মতামত লিখুন :