নানারকম অজুহাতে গ্রাহকের দাবিকৃত পাওনা বিমার ২ হাজার ৬৩৫ টাকা আটকে রেখেছে, দেই-দিচ্ছি বলে দিচ্ছে না। ওরা হাসিনা সরকারের দোসর। পাওনাদারদের এমনই ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা গেছে।অসুস্থতা,দুর্ঘটনাসহ বিপদে-আপদে বিশ্বজুড়ে মানুষের ভরসার কেন্দ্র ‘বিমা’। বিমা পলিসি করা থাকলেই হাসপাতালের বিল পরিশোধ বা দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কোনো চিন্তা করতে হয় না গ্রাহককে। গ্রাহকের হয়ে বিমা কোম্পানিই সব শোধ করে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিমা খাত এখনো সেই ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি। বিপদগ্রাস্থ গ্রাহক বিমা দাবি নিয়ে পায়ের জুতা ক্ষয় করে ফেললেও অর্থ পরিশোধ নিয়ে গড়িমসি শেষ হয় না সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানির। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) এক অনিরীক্ষিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের ৪৬টি বিমা কোম্পানি গ্রাহকের বিমা দাবির প্রায় ২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেনি। এ হিসাব গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বিমাসংশ্লিষ্টরা বলছেন,দাবি পরিশোধে বিমা কোম্পানিগুলোর অনীহা, কাগজপত্র ও সার্ভে প্রতিবেদনের দোহাই এবং পুনর্বিমার নামে নানা বাহানা করেই বছরের পর বছর গ্রাহকের পাওনা টাকা দিচ্ছে না কোম্পানিগুলো। এ কারণে বিমা খাতের ওপর মানুষের আস্থা দিন দিন কমছে।এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম বলেন, বিমা খাতের প্রধান সমস্যা দাবি পরিশোধ না করা। এ কারণে বিমা খাত এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।
আইডিআরএর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী,২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ৪৬টি নন-লাইফ,অর্থাৎ সাধারণ বিমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকের বিমা দাবি ছিল ৩ হাজার ৮৭১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে ১ হাজার ২৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ফলে অনিষ্পন্ন আছে ২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকার বিমা দাবি। এ ক্ষেত্রে দাবি নিষ্পত্তির হার মাত্র ৩২ শতাংশ। সেই হিসাবে ৬৮ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেনি কোম্পানিগুলো।
বিষয়টি নিয়ে বিমা কোম্পানিগুলোর এমডিদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরামের জয়েন্ট সেক্রেটারি এস এম নুরুজ্জামান বলেন, বিমা দাবি পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য আইডিআরএ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে আরও আন্তরিক হতে হবে। দ্রæত বিমা দাবি পরিশোধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে।
গ্রাহকদের বিমার টাকা পরিশোধ না করার শীর্ষে রয়েছে সিকদার ইনস্যুরেন্স লিমিটেড। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির কাছে গ্রাহকদের বিমা দাবির পরিমাণ ছিল ২৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে তারা পরিশোধ করেছে মাত্র ১ কোটি ৪৭ টাকা। অর্থাৎ ৯৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি। সিকদার ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রফিক বলেন, ৫ আগস্টে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এই বিমা দাবি সাধারণ বিমা কোম্পানিতে রয়েছে। এসবিসি থেকে দাবির অর্থ পেলেই পরিশোধ হয়ে যাবে।সরকারি বিমা সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হারুন-অর-রশিদ বলেন,এসবিসি বিমা পরিশোধ না করার বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে আমরা বিমা কোম্পানির দাবি বাবদ ২০২৪ সালে ৪৬৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি।’
বিমা দাবি পরিশোধ না করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নর্দান ইসলামী ইনস্যুরেন্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির কাছে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দাবির পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে তারা। টাকার হিসাবে কোম্পানিটির অনিষ্পন্ন বিমা দাবির হার ৯২ শতাংশ।এ বিষয়ে নর্দান ইসলামী ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের সিইও চৌধুরী গোলাম ফারুক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, এস আলম-কান্ডে কারণে কোম্পানির বিমা দাবির পরিমাণ বেড়েছে।সবচেয়ে কম বিমা দাবি পরিশোধ করা কোম্পানির তালিকায় তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে থাকা বাকি তিন কোম্পানি হলো ঢাকা ইনস্যুরেন্স, পিপলস ইনস্যুরেন্স এবং সাধারণ বীমা করপোরেশন। প্রতিষ্ঠান তিনটি যথাক্রমে ৯ দশমিক ২২, ৯ দশমিক ৩৬ এবং ১২ দশমিক ১০ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেছে।
বিমা দাবি পরিশোধ না করার পেছনে তিনটি কারণকে দায়ী করেছে সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। কারণগুলো হলো গ্রাহকদের যথাযথ ডকুমেন্ট না থাকা, ডকুমেন্ট থাকলেও সার্ভের রিপোর্ট পেতে দেরি হওয়া এবং পুনর্বিমা পেতে সাধারণ বিমার গড়িমসি।
এনিয়ে সিকদার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পরামর্শক মীর নাজিম উদ্দিন বলেন, বিমা দাবি পরিশোধের প্রধান বাধা হলো সার্ভে রিপোর্ট না পাওয়া। আমরা দেখছি ঘটনা ঘটছে, কিন্তু তারপরও সার্ভে রিপোর্ট পাচ্ছি না। সার্ভে রিপোর্ট পেতে লাগে টাকা। এমনও হয় যে মূল টাকার চেয়ে বেশি টাকা চলে যায় সার্ভে রিপোর্টের জন্য। সার্ভে রিপোর্ট হলো সোনার হরিণ।আইডিআরএর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিমা দাবি পূরণে শীর্ষ রয়েছে রূপালী ইনস্যুরেন্স,জনতা ইনস্যুরেন্স,সোনার বাংলা, ইস্টল্যান্ড, নিটল এবং প্রাইম ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এই কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত বিমা দাবি পরিশোধ করেছে।
আইডিআরএ উপপরিচালক ও মুখপাত্র মো. সোলাইমান বলেন, ‘প্রতিবেদনটি হাতে পেয়েছি। আইডিআরএ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। বিমা দাবির অধিকাংশ বিষয়টির সঙ্গে সাধারণ বিমা কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আইডিআরএ কর্তৃপক্ষ এসবিসির কথা বলে সমাধানের পথ বের করবে।’গ্রাহকদের করণীয়-বিমা দাবি আদায়ের জন্য গ্রাহককে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিমা বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের পরামর্শ প্রথমত, দাবির সপক্ষে সব কাগজপত্র নির্ভুলভাবে জমা দিয়ে আবেদন করতে হবে। আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে দাবির অর্থ না পেলে আইডিআরএতে অভিযোগ করতে হবে। তাতেও যদি কাজ না হয়,তবে আইডিআরএর বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটির কাছে আবেদন করতে হবে। এতেও ব্যর্থ হলে দ্রæত মামলার মাধ্যমে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে।তথ্যসুত্র-আজকের পত্রিকা
আপনার মতামত লিখুন :