‘আমি তোমার ক্ষতি করতে চাই।’‘আমি যখন এ মেসেজটি পড়েছি। এরপর কয়েক রাত আমি ঘুমাতে পারিনি’, বলছিলেন ২৫ বছর বয়সী দুবাইয়ের বাসিন্দা জেনিশ শাহ। ছয় শব্দের একটি মেসেজ তাকে আতঙ্কিত করেছিল। তাতে লেখা ছিল, ‘আমি তোমার ক্ষতি করতে চাই।’
মেসেজ পাঠানো ওই ব্যক্তিটি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি জেনিশকে পরামর্শ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি বলেন, সত্যি বলতে কি, আমি অনেক সতর্ক ছিলাম। কারণ, অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তবে তিনি ধারবাহিক কোনো কাজের কথা বলেননি।
জেনিশ প্রস্তাবটি সত্য কি না যাচাই করতে ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু অল্প সময় পরে জেনিশের ধারণা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। কারণ, উচ্চপদস্থ ওই কর্মকর্তা ‘ক্ষতি করতে ভালোবাসি’ বলে আরেকটি মেসেজ দেন। পরে যখন লোকটি জেনিশের সঙ্গে দেখা করেন, তখন মেসেজের বার্তাটি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। যাইহোক, বিষয়টি জেনিশের ভালো লাগেনি, বিরক্ত হয়ে তাকে ব্লক করে দিয়েছিলেন।
অনলাইনে হয়রানি নারীদের জন্য একটি নতুন ঘটনা। যাইহোক, লিঙ্কডইন অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো নয়। এটি পেশাদারদের প্ল্যাটফর্ম। লিঙ্কডইনকে কর্মক্ষেত্র বিস্তারের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। এ ধরনের হয়রানিমূলক বার্তা এই প্ল্যাটফর্মে আপত্তিকর বলে বিবেচিত হয়। তবে জেনিশ একা নন, দুর্ভাগ্যক্রমে, এ ধরনের আপত্তিকর মেসেজের ফলে লিঙ্কডইনে ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণা বহুগুণ বেড়েছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গেøাবাল ফটো স্টুডিও অ্যাপ দ্বারা পরিচালিত ১০০০ জনেরও বেশি মানুষের ওপর এক জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৯০ শতাংশ লিঙ্কডইন ব্যবহারকারী নারী রোমান্টিক বা অপ্রত্যাশিত মেসেজ পান। এসব মেসেজের মধ্যে ৩০ শতাংশেরও বেশি ব্যক্তিগত বা অন্তরঙ্গ তথ্য চাওয়া হয়েছে। জরিপে আরও দেখা গেছে,৭৪ শতাংশেরও বেশি নারী এই ধরনের বার্তাগুলোর কারণে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে তাদের কার্যকলাপ কমিয়ে দিয়েছে।
খারেজ টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেনিশ জানান, বছরের পর বছর তিনি এমন অপেশাদার মেসেজ পান। তিনি বলেন, প্রথমে তারা পেশাগত সহায়তা চান। এরপর সাধারণ কথাবার্তা বলতে থাকেন। কিন্তু ১০ থেকে ১৫ বার মেসেজ দেওয়ার পর তারা ফোন নম্বর বা ইনস্টাগ্রাম আইডি চেয়ে বসেন। এজন্য এখন নতুন কোনো মেসেজ আসলে আমার সন্দেহ হয়। উদ্দেশ্য প্রণোদিত কি-না তা ভেবে অনেক সময় কাউকে সহায়তাও করি না।
বিশেষ কারণ উল্লেখ করে জেনিশ বলেন, কথা বার্তায় অসংলগ্ন হওয়ায় ডেটিং অ্যাপ টিন্ডার থেকে কয়েকজনকে বøক করি। এরপর তিনি লিঙ্কডইনে খুঁজে পেয়ে তিনি সেখানে মেসেজ করেন। ব্যাংক শিল্পে কাজ করা ৩৮ বছর বয়সী দুবাইয়ের বাসিন্দা বাওয়ান অরোরা বলেন, একবার তিনি চাকরি খোলার ফলোআপ হিসাবে একটি বিরক্তিকর বার্তা পেয়েছিলেন। এর মধ্যে কিছু মেসেজের কথা অরুচিকর ছিল। তিনি বলেন, মেসেগুলো ছিল খুবই কুরুচিকর এবং অপেশাদারী। আমি বিবাহিত কি না জানতে চেয়ে আমার ডাক নামও জানতে চায়। এরপর আমি মেসেজের উত্তর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
মেসেজের সীমানা নির্ধারণ:কিছু নারীদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের জন্য এক নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা দরকার। যেমন- ‘হাই দেয়ার’ বলে একজন অপরিচিত ব্যক্তি ফ্রিল্যন্সার জর্জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। যদিও মেসেজটিতে কোনো অপ্রীতিকর বার্তা ছিল না। জর্জিয়া বলেন, নারীরা সব সময় এ ধরনের বার্তা পান। প্রায় সবসময়ই নারীরা হয়রানির মধ্যেই থাকেন বলে জানান তিনি।
একটি পেশাদার প্ল্যাটফর্ম থেকে বার্তা পান। পরে সেখানে থেকে দুই ঘণ্টা কোনো টেক্সট বা বার্তা না আসায় জর্জিয়ার কাছে মনে হয়েছে, এটি অপেশাদার যোগাযোগের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এতে কথা বার্তা খুবই আক্রমণাত্মক মনে হয়েছে বলে জানান জর্জিয়া।
কেন নারীরা লিঙ্কডইনের মতো একটি প্ল্যাটফর্মে পুরুষদের সঙ্গে এইভাবে যোগাযোগ করেন না এমন একটি প্রশ্নে এক সাংবাদিক তাকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চান।
নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে জর্জিয়ার দেওয়া পোস্টে বেশ কয়েকজন নারী তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন দ্বন্দ্বে জড়িত হওয়ার পরিবর্তে এ ধরনের অলস বার্তাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া,বøক করার পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও অন্যান্যরা অনেক কঠোর আচরণ করেন।‘এখানে আছেন’ বলে মেসেজ দেওয়া ব্যক্তি সবচেয়ে প্রতারক। তাদেরকে আমলে না নেওয়া যুক্তিযুক্ত- অতি সংবেদনশীল হবেন না, একজন মন্তব্যকারী পোস্টে এ কথা বলেন। আরেকজন বলেন, যদি এটি সত্য হয়, তবে যখন কেউ আপনাকে বলবে-কি বিষয়ে কথা বলতে চান, তখন আপনি আত্মরক্ষামূলক হবেন।
জর্জিয়া ব্যাখ্যা করেন,আমি তার উত্তর দিলে তিনি ক্ষমা চান। এছাড়াও কাজ সম্পর্কিত একটু খবর পাওয়া যায় তার কাছে। কিন্তু এর ফলে তিনি স্পষ্ট সীমানা অতিক্রম করে আমাকে আক্রমণাত্মক বলেছেন। পুরুষের সেই ক্রোধ আমার ভালো লাগেনি। এটাই আমাকে রাগান্বিত করেছে।
বিষাক্ত পুরুষত্ব:নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কে শুধুমাত্র নারীই সন্দেহ করে, তা নয়। দুবাইয়ে বাস করা অর্পণ ঘোষ বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ ধরনের ঘটনা খুবই সাধারণ। কারণ, পুরুষরা এমন ঘটনা খুবই পছন্দ করে।
খালেজ টাইমসকে অর্পণ ঘোষ বলেন, অনেক পুরুষ সিনেমার মতো এই ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠেন যে, পুরুষ কোনো নারীর প্রতিরক্ষা ভেঙে দিয়ে তার ওপর জয়লাভ করবে। তারা মনে করেন, যদি তারা কোনো নারীর প্রতি আগ্রহী হন, সেই নারীকে যখন যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যেতে পারবেন। তিনি বিশ্বাস করেন, পুরুষত্ব বা পুরুষত্বের এ ধারণাকে অতি সরলীকরণ করা হয়েছে। একজন মানুষকে অবশ্যই তার পছন্দ থাকতে হবে। যদি ইচ্ছার ব্যাপারটি পুরো অস্বীকার করা হয়, তাহলে ওই নারীর সঙ্গে বাজে আচরণ হয়ে থাকতে পারে।
এ ধরনের বিষয়গুলোকে গুরুতর সমস্যা।এটি অনলাইনে ক্রমবর্ধমানভাবে আলোচনা করে নারীদের অসম্মানজনকভাবে কথা বলা হচ্ছে। এখানে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকেই এর থেকে বের হতে পারছে না। আমি ম্যানোস্ফিয়ার নামে একটি পোর্টাল থেকে এ ধরনের অনেক ভিডিও পেয়েছি, যেগুলোতে নারীদের সঙ্গে পুরুষের সম্পর্ক নির্ণয়ে সীমানা উপেক্ষা করার বিষয়ে পরামর্শ দেয়। তবে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্য নিয়ে অর্পণ বিরক্ত।
দ্বিমুখী সমস্যা?এটা বলা যাবে না যে,নারীরা নিজেরাই অপেশাদারীভাবে প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন না। এটা কোনো গোপন বিষয় নয়, যে নারীরা প্রেম করতে চাইছেন, তারাও পেশাদার প্ল্যাটফর্মে সঙ্গী খুঁজতে আসেন, বিশেষ করে লিঙ্কডইনে।
গত বছর একজন টিকটকার নেটওয়ার্কিং সাইটের ফিল্টারগুলো ব্যবহার করে কিভাবে সঙ্গী খুঁজে পাওয়া যায় এমন একটা ভিডিও তৈরি করেন।পরে তা ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিওটি দুই মিলিয়নেরও বেশি ভিউ হয়। এতে ১ লাখ ৫৬ হাজার মানুষ সেখানে লাইক দেন। হাজারো ব্যবহারকারী এতে মন্তব্য করে।
গত বছর এ সংক্রান্ত সমীক্ষার প্রতিক্রিয়ায় লিঙ্কডইনের একজন মুখপাত্র ফোর্বসকে বলেছিলেন, আমাদের নিয়ম লঙ্ঘন করে অযাচিত সম্পর্ক, হয়রানি লিঙ্কডইন কখনও অনুমোদন করে না। আমাদের নীতি অনেক স্পষ্ট, কোনো অপেশাদারী কাজ এখানে সমর্থন করা হয় না। পুরুষ ও নারীদের যোগাযোগের জন্য আদর্শ সমাধান কি হবে?অর্পণ যখন বুঝতে পেরেছিলেন,সোশ্যাল মিডিয়াতে পারস্পরিক যোগাযোগ আরও ভাল হতে পারে, এজন্য তিনি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, লিঙ্কডইন একটি পেশাদার প্ল্যাটফর্ম। এটি সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
আপনার মতামত লিখুন :