প্রশাসনের কেন্দ্রে অগ্নিকান্ডের দুই দিন পরও সচিবালয়ে আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি। আগুনে ৭ নম্বর ভবনের ছয় তলা থেকে নয় তলা পর্যন্ত সকল সিসিটিভি ও ফুটেজসহ ডিভিআর (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার) পুড়ে গেছে। রাষ্ট্রের এমন একটি সুরক্ষিত স্থানে অগ্নিকান্ড নিয়ে সারাদেশে নানা ধরনের প্রশ্নের উঠেছে। ৩০ ঘন্টা ধরে ভবনের সকল কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকার পরও একই সময়ে তিনটি স্থানে কীভাবে আগুন লাগলো, সেই রহস্যের জট খুলছে না।শুক্রবার(২৭ডিসেম্বর) ক্ষতিগ্রস্থ ভবন পরিদর্শন করেছেন তদন্ত কমিটি। অন্যদিকে সিআইডির ক্রাইম সিন ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে।
এদিকে সাত নম্বর ভবনের আটতলা থেকে আগুনে পুড়ে যাওয়া কুকুরের মরদেহ নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। মৃত কুকুরটি ফরেনসিক বিভাগে নেওয়া হয়েছে। কুকুরটি ৮ তলায় কীভাবে উঠলো তা নিয়ে চলছে আলোচনা। কুকুরটির শরীরে বিষাক্ত কিছু আছে কিনা তা জানান চেষ্টা করছে ফরেনসিক বিভাগ।
সন্দেহে তৃতীয় পক্ষ! কেউ কেউ বলছেন, বিগত সরকারের মেগা প্রকল্পের কাজের ফাইল তলব করায় বর্তমান সরকারের মধ্যে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা চক্রটির থলের বিড়াল বেরিয়ে যেতে পারে বলে পরিকল্পিতভাবে এ ধরনের কাজ ঘটানো হয়েছে। কারণ সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের মেগা প্রকল্পের ফাইল তলব করা হয়েছে। বুধবার গভীর রাতের রহস্যজনক এ আগুনের সূত্রপাত হতে দেখা যায় এই তিনটি মন্ত্রনালয়ের অফিস থেকেই। সচিবালয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারের সকল গোয়েন্দা সংস্থা সার্বক্ষণিক কাজ করে। রাষ্ট্রের এসব শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ যদি এ কাজ করে থাকে, তাহলে সেটি হবে দুঃসাধ্য- এমনই মনে করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তবে সরকারের কোনো পক্ষই এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না। তারা বলছে, বিষয়টি তদন্ত করছে উচ্চতর তদন্ত কমিটি। এখানে যারাই কাজটি করে থাকুক, কোনো পক্ষের স্বার্থরক্ষার জন্যই কাজটি করেছে। তবে তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
এদিকে ঘটনার দিন সচিবালয়ের ভিতরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত সকল সদস্যদের নামের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল তল্লাশি করা হবে।
ঘটনাস্থলে তদন্ত কমিটি-সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সচিবালয় ঘিরে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কড়া পাহারা দেখা যায়। সকালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আট সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্যরা সচিবালয়ে ঢোকেন। পরে তারা সচিবালয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ওসমান গণি, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল, বাংলাদেশপ্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক তানভীর মনজুরসহ তদন্ত কমিটির অন্য সদস্য অংশ নেন। তারা সবাই আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবন পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শন শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ ভবন পরিদর্শন করেছি। তদন্ত কাজটা শুরু হয়েছে। তদন্ত চলছে। শনিবার (আজ) তদন্ত কমিটির সদস্যরা আবার বৈঠক করবেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত শেষ না হওয়ার আগে আগুন লাগার কারণ নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। সচিবালয়ের ভেতরের অবস্থা বৃহস্পতিবারের মতোই রয়েছে। এদিকে গতকাল সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটও ক্ষতিগ্রস্থ ভবন পরিদর্শন করেন।
আলামতের সন্ধানে সিআইডির ক্রাইমসিন-সিআইডি সূত্র জানিয়েছে শুক্রবার সকালে সচিবালয়ের পুড়ে যাওয়া ৭ নম্বর ভবনে ছয়টি গুরু--গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। বিকাল পর্যন্ত ওই ভবনের ভিতরেই ক্রাইমসিন ইউনিট অবস্থান করেছে। তবে ভবনের ছয় তলা থেকে নয় তলা পর্যন্ত বিভিন্ন ফ্লোরে লাগানো সিসি ক্যামেরা পুড়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও বিভাগে রাখা ডিভিআর (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার) পুড়ে গেছে। ভবনের আশেপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশের একটি টিম। সরজমিনে দেখা গেছে, গতকাল সকাল থেকেই সচিবালয়ের মূল ফটকে পুলিশ ছাড়াও সেনাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। তদন্ত কাজের সঙ্গে জড়িত, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যরা ছাড়া কাউকেই প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো সচিবালয়ের সব ভবনে বিদ্যুত্ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।
কুকুরের মরদেহ নিয়ে নানা প্রশ্ন-সাত নম্বর ভবনের আটতলা থেকে আগুনে পুড়ে যাওয়া কুকুরের মরদেহ নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। মৃত কুকুরটি ফরেনসিক বিভাগে নেওয়া হয়েছে। কুকুরটি ৮ তলায় কিভাবে উঠলো তা চলছে আলোচনা। কুকুরটির শরীরে বিষাক্ত কিছু আছে কিনা তার রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টা করছে ফরেনসিক বিভাগ। কুকুরটি ৮ম তলায় কিভাবে উঠলো তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা কল্পনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, আমাদের দেশে বিদেশী কুকুরকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে অভ্যাস গড়ে তোলা হয়। কেউ ঘরে রাখার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে অভ্যাস গড়ে তোলে। আবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো বিদেশী কুকুরকে শিকারী কুকুর হিসাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলে। কিন্তু আমাদের দেশী প্রজাতির কুকুর যাকে আমরা স্ট্রিট ডগ বলে থাকি, তাদের চলাফেরা একেবারে ভিন্ন। স্ট্রিট ডগ পরিচিত এলাকায় থাকে। যেখানে সে খাবার পায় সেখানেই তার একটি প্রভূ ভক্ত জগত গড়ে তোলে। কোনো ব্যক্তির ওপর সন্দেহ হলেই সে ঘেউ ঘেউ করে। আবার জনশূণ্য স্থানে সে বেশি সময় থাকবে না। সে খাবারের স্থানে চলে আসতে চাইবে।
সচিবালয়ের ভেতরে আমি দুই-তিনবার গিয়েছি। কিন্তু ভবনগুলোতে কখনই কুকুর ঘোরাঘুরি করতে দেখিনি। এ ক্ষেত্রে বাইরের কুকুর এত নিরাপত্তা বেষ্টনী ফাঁকি দিয়ে কখনই সচিবালয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে বা লিফটে করে আটতলায় যাবে না। আর কলাবশিবল গেট খোলা পেয়ে একটি কুকুর কখনই গোপনে সিঁড়ি বইবে না যদি সেখানে খাবারের উত্সা থাকে। অনেক সময় স্মেলিং পাওয়ারের (গন্ধ) কারণে শক্রু পক্ষের সন্ধান পেলে কুকুর কিন্তু ঘেউ ঘেউ করে ওই স্থানে যাবে। এমন যদি হয়, সেক্ষেত্রে তো সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকার সদস্যরাই ওই কুকুরকে প্রতিরোধ করবে। আমার কাছেও ওই ভবনের আট তলায় কুকুরের মরদেহ উদ্ধার নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।
সচিবালয়ের ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থা-সচিবালয়ে ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে যে কেউ চাইলে ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে। কোন সংগঠন বা অন্য কোন পক্ষ দাবি-দাওয়ার দাবি নিয়ে সবিচালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে ফেলছে। অনেকে মিছিল নিয়ে অনেকটা জোর করেই সচিবালয়ের ভেতরেও চলে যাচ্ছে। এই নিয়ে প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনও ত্যক্ত-বিরক্ত। গুরুত্বপুর্ন এই স্থাপনায় যে পরিমান নিরাপত্তা থাকা দরকার তা নেই বলে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পর কয়েকবার বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে কোন কোন সংস্থা অনুমতি ছাড়াই সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে। এমনকি সচিবালয়ের ভেতরে মিছিল শ্লোগান পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। আবার কোন কোন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার রুমের সামনে গিয়ে অবরুদ্ধ পর্যন্ত করে রাখা হয়েছে। যানবাহনও তল্লাশি না করেই ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়। বুধবার ২৫ ডিসেম্বর রাতে সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে ভয়াবহ আগুন লাগার পর নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আসে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কমকর্তা একজন কর্মকর্তা বলেন, পুরা সচিবালয়ে নিরাপত্তার ঘাটতি আছে। আমরা প্রশাসনকে বারবার বলেছি কঠোর নিরাপত্তার বলয়ের ব্যবস্থা করতে। বুধবার রাতেও নিরাপত্তা কম ছিল বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে এমন অগ্নিকান্ড নিয়ে বিন্দুমাত্র অবহেলা থাকলে তা প্রকাশ করতে হবে।তথ্যসহায়তা-ইত্তেফাক
আপনার মতামত লিখুন :