বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১

আলাউদ্দিনের হাতে আলাদিনের চেরাগ

আইন-অপরাধ ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২৪, ১২:১৫ পিএম

আলাউদ্দিনের হাতে আলাদিনের চেরাগ

দুর্নীতির প্রতিযোগীতায় এগিয়ে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। তার হাতে এসে ধরা দেয় আলাদিনের চেরাগ। সম্পদেও পাহাড় দেখে তাই এলাকায় বলা হয় আলাউদ্দিনের হাতে আলাদিনের চেরাগ। ১৯৮৬ সালে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৯৭-২০০১ সালের একসময় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই সময়ে প্রটোকল অফিসার হন। আর এই অফিসার পদটাই তার জীবনে আলাদিনের চেরাগ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২০০৯ সালের পর আওয়ামী রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো পদপদবি না থাকার পরও নাসিমের হাতে টাকা আসতে থাকে স্রোতের মতো। প্রশাসনের বদলি, পদায়ন করে রোজগার শুরু। কেনেন বেশ কয়েকটি লাইটার জাহাজ। সেগুলো দেশের বিভিন্ন নৌরুটে এখনও চলছে। এরপর একসময় তিনি হয়ে যান ফেনী আওয়ামী রাজনীতির অভিভাবক। আসতে থাকে কমিশন। চাউর আছে-ফেনী ক্যাডেট কলেজের পাশে নাসিমের বাড়িটি তাকে ‘অভিভাবকের জন্য উপহার’ হিসেবে দিয়েছিলেন ফেনী-২আসনের সাবেক এমপি নিজাম হাজারী। স্থানীয় ও প্রশাসনিক সুত্রগুলো থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। সুত্র জানায়
নাসিম অবশ্য বিষয়টি অস্বীকার করেছেন-দাবি করেছেন বাড়িটি তার নিজের টাকায় করা। সেই জমির মালিকের অভিযোগ,তার কাছ থেকে জবরদখল করে ডুপ্লেক্স এই বাড়িটি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের অস্ত্রবাজ থেকে নিজাম হাজারী গডফাদার হয়ে ওঠার মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এই চেরাগী নাসিম। সভা-সমাবেশে নাসিমকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো ‘আমার অভিভাবক’ বলে। দলে বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বা দায়িত্বে না থাকলেও জেলার সব জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছিলেন নাসিমের অনুগত।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে তখনকার ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসিমকে স্যার সম্বোধন করে চেয়ারে বসতে অনুরোধ করতেও দেখা গেছে। তখনকার সময়ে ফেনীর ডিসি-এসপির যোগদানের প্রথম কাজ হচ্ছে- নাসিমের সঙ্গে দেখা করা। তাকে না পেলে নাসিমের বাবা-মায়ের দোয়া নিতেও দেখা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার পদ পেয়ে অর্থাৎ আলাদিনের চেরাগ পেয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান নাসিম। ফেনীর আওয়ামী রাজনীতিতে সবার কাছে তিনি অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃত। ৫ আগস্টের পর তার নামে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি হয়েছে-‘পিও অভিভাবক পালাইছে।’ নাসিম চলতি ২০২৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হন। তার আগে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত অভিভাবক। নেতাকর্মীদের ভাষ্য ছিল- ‘নাসিম নিজে মন্ত্রী নন, তবে মন্ত্রী বানান।’
যেভাবে উত্থান : নাসিমকে আগে সবাই শেখ হাসিনার ‘প্রটোকল অফিসার’ হিসেবেই চিনতেন। এর বাইরে সুদর্শন,স্মার্ট নাসিম হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। শেখ রেহানার অবৈধ টাকার সংগ্রাহকও বলা হতো নাসিমকে।
ছাগলনাইয়ার বাসিন্দা আবুল হাসান জানান,২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর কোনো পদে না থেকেও জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন নাসিম। পাশাপাশি প্রভাবশালী একজন আবাসন ব্যবসায়ীসহ বড় কয়েকটি ব্যবসায়িক গ্রæপের স্বার্থ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নিজেও বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন ব্যবসায় অংশীদার হন। পাশাপাশি সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজম,উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, বাহাউদ্দিন নাছিম ও চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির ও পরবর্তীতে ছাগলনাইয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মজুমদার ও নিজাম হাজারীসহ একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে।
ফেনী জেলা আওযামী লীগের সভাপতি হাফেজ আহমদ জানান, নাসিম ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৬ সালে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নাসিম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলে তিনি বিরোধীদলীয় নেতার প্রটোকল কর্মকর্তা হন। পরবর্তী সময়ে তিনি সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন।
একাধিক সূত্রে জানা যায়,আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ইতোমধ্যে অভিযোগ জমা পড়েছে। গত ১৫ বছরে তিনি অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জন ও পাচার করেছেন বলে এই অভিযোগে বলা হয়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় নাসিম নিজের ও স্ত্রীর নামে ১০৮ কোটি টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন। বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৩ কোটি ৫৭ হাজার ২৯৫ টাকা এবং তার স্ত্রীর ৬৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৫০ টাকা। এই হিসাবের বাইরেও নাসিম ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশ-বিদেশে নামে-বেনামে রয়েছে বিপুল অর্থসম্পদ। নাসিমের মেয়ে কানাডায় থাকেন। বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি মেয়রের কাছে কোটি কোটি টাকা পাচার করেন।
ফেনীর দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির গডফাদার ছিলেন জয়নাল হাজারী। তার পতনের পর ফেনী জেলা আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আলাউদ্দিন নাসিম। জয়নাল হাজারীর জায়গায় আসেন নিজাম হাজারী। সাখাওয়াত হোসেন নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান,জোর করে জমি নিয়ে ফেনীর পরশুরামের চিথলিয়ায় নির্মাণ করা হয়েছে তার নামে কলেজ। তার সম্পর্কীয় ছোট ভাই নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সাজেল টানা তিনবারের পরশুরাম পৌরসভার মেয়র। পরশুরামে তার ইশারায় চলে সব। নাসিমের ইশারায় সাজেল গড়ে তোলেন ত্রাসের রাজত্ব।
স্থানীয় বাসিন্দা দ্বীন মোহাম্মদ জানান,নাসিমের বাড়ি‘ সীমান্তবর্তী উপজেলা পরশুরাম পৌরসভার গুথুমা গ্রামে। তিন পাশে সীমান্ত। তার ভাই সাজেলের ছত্রছায়ায় এই সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা থেকে অবৈধভাবে শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক আসে বাংলাদেশে। ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকও এই সীমান্ত দিয়ে দেশে আসত। এসব চোরাচালানের আরেক নিয়ন্ত্রক নাসিমের ছোট ভাই জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী পাপ্পু। বালুমহাল,টেন্ডারবাণিজ্য, সালিশিবাণিজ্য,নিয়োগবাণিজ্য ও সীমান্ত থেকে গরু পাচার এসব করতেন তারা।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আলাউদ্দিন নাসিম, তার ভাই জালাল উদ্দিন আহমেদ ও চাচাতো ভাই সাজেলসহ তাদের সহযোগীরা আত্মগোপনে চলে যান। বর্তমানে তারা ভারতে আছেন বলেন জানা গেছে।
যেভাবে গড়ে তোলেন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজ-ফেনীর পরশুরামে ৩০ একর জায়গায় ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত করা হয় আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজ। স্থানীয়দের অভিযোগ, জোরপূর্বক ও ভয় দেখিয়ে নামমাত্র মূল্য পরিশোধ করে কলেজের জন্য কৃষিজমির জায়গা দখল করে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিলেন সাজেল। ফিল্মিস্টাইলে লাল কাপড় লাগিয়ে এস্কেভেটর দিয়ে শুরু করেন মাটি কাটা। লাল পতাকা টাঙানোর পর বলা হতো, এই জমিগুলো অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। পরে দেখা যায়, অধিগ্রহণ নয়, মানুষ জানতে পারেন দখল করা হয়েছে। নাসিম উত্তরাঞ্চল নয় পুরো জেলার আওয়ামী লীগের মাফিয়া। ছোট মাফিয়াদের অভিভাবক। তার জায়গা দখল করবে কার সাহস আছে প্রতিবাদ করার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, নাসিম কলেজের নামে দেড় বিঘা জমি জোর করে নিয়ে নেওয়া হয়। জমির মূল্য ১৫ লাখ টাকা হলেও পরিশোধ করা হয় ৫ লাখ টাকা। ৫ লাখ টাকা না নিলে কোনো টাকাই দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন।
কলেজের পাশে বাসিন্দা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমি দখল করেছেন আলাউদ্দিন নাসিম। নাসিমের নামে নিজের নামে ২০ শতাংশ জমি দানপত্র তৈরি করে লিখে নেন। এই জমির বাজারমূল্য অনেক বেশি। কিন্তু তাকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩ লাখ টাকা।

 

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!