দেশে সরকারি পর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ এবং মা-শিশু স্বাস্থ্য ও কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার ওষুধের তীব্র সংকট চলছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে বিনামূল্যে মা ও শিশুদের এসব সামগ্রী সরবরাহ করে। বর্তমানে ৯ ধরনের উপকরণ ও ওষুধ কোনো উপজেলা গুদামে নেই। গত পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে এসব সামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। আট ধরনের সামগ্রীর মজুদ শূন্যপ্রায়। এ ছাড়া অন্যান্য সামগ্রীর মজুদও চাহিদা ও সরবরাহ অনুপাতে কম।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একজন বিভাগীয় পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কমপক্ষে ৬ মাসের ও সর্বোচ্চ ১০ মাসের মজুদ থাকতে হয়। এটা আদর্শ মান। এটা মেনেই আমরা সরবরাহ করি ও এসব উপকরণ-ওষুধ কিনতে হয়, যাতে মজুদশূন্য না হয়। কিন্তু সঠিক সময়ে এসব সামগ্রী কেনা হয়নি বলেই মজুদ শেষ হয়ে গেছে। এ কেনাকাটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।
এ কর্মকর্তা বলেন, জটিল প্রক্রিয়ার কারণে এসব সামগ্রী কিনতে কিছু সময় লাগে। কেনাকাটার প্রক্রিয়াটা যদি সময়মতো শুরু করতে পারে, তাহলে সব মিলে চার-ছয় মাস সময় লাগে কিনতে। আর যদি সরাসরি কেনে তাহলে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগে। ফলে এখনো ক্রয় প্রক্রিয়া যে ধাপে রয়েছে, তাতে ঘাটতি দেখা দেওয়া সামগ্রীগুলো গুদামে এসে পৌঁছতে আরও কমপক্ষে তিন-চার মাস সময় লাগবে।
কিছু কিছু সামগ্রী গুদামে আসতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (প্রকিউরমেন্ট, স্টোরেজ অ্যান্ড সাপ্লাই ম্যানেজমেন্ট) এটিএম নজমুল হুদা। তিনি বলেন, ‘কেনাকাটা চলছে। কিছু সামগ্রী ইতিমধ্যেই কেনা হয়েছে। কিছু সামগ্রী শিগগির গুদামে ঢুকবে ও কিছু পাইপলাইনে আছে। এসব সামগ্রীর মধ্যে ইনজেকটেবল দু-এক দিনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে। এর আগে কনডম কেনা হয়েছে। তবে কেন মজুদশূন্যতা, কে কীভাবে এসব উপকরণ কিনেছে, কেন কিনতে দেরি হয়েছে, সেটা আমি বলতে পারব না।’
সংকটের কারণে পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চাহিদা বেড়ে গেলে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু ও প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব সামগ্রীর চাহিদা পূরণ করা না গেলে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ ও সমগ্র প্রজনন হার বেড়ে যাবে। বিশেষ করে সমগ্র প্রজনন হারের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে। কারণ দেশে সমগ্র প্রজনন হার ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২ দশমিক ৩ শতাংশে বিরাজ করছে। অথচ ২০১৫ সালের মধ্যে এই হার ২ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল।’
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির অপূর্ণ চাহিদার হার ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্যে পৌঁছানোর কথা। এখনো সেটি ১০ শতাংশের মতো বাকি আছে। কিশোরীদের মধ্যে বাকি ১২ শতাংশ। আর পাঁচ বছরের মতো সময় আছে। ফলে পরিবার পরিকল্পনা উপকরণ ঠিকমতো সরবরাহ করা না গেলে অপূর্ণ চাহিদার আন্তর্জাতিক ও দেশের নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে এবং অধিদপ্তরের সাপ্লাই চেইনের তথ্য বিশ্লেষণ করে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ এবং মা-শিশু স্বাস্থ্য ও কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার ওষুধের ঘাটতির এসব তথ্য জানা গেছে।
৫ মাস ধরে নেই ৯ উপকরণ : গত পাঁচ মাস দেশের কোনো উপজেলায় জন্মনিরোধক ইনজেকশন (ডিপো-প্রোভেরা) নেই। অথচ প্রতি মাসে প্রায় ৯ লাখ ভায়ালের বেশি ইনজেকশনের চাহিদা রয়েছে। নেই ক্লিনিক্যাল গর্ভনিরোধক উপকরণ ইমপ্ল্যানন। মাসে এ উপকরণের চাহিদা ৩৩ হাজারের বেশি।
গত এক বছর নেই নরমাল ডেলিভারি কিট। এ প্যাকেটে নিরাপদ প্রসবের জন্য পাঁচ ধরনের উপকরণ থাকে। এগুলো হলো সাবান, প্লাস্টিক শিট, নাভির ক্লিপ, সুতা, নাভি কাটার ব্লেড ও তুলা। এ কিট সংক্রমণজনিত কারণে মা ও শিশুমৃত্যু রোধ করে।
নিরাপদ স্বাভাবিক সন্তান প্রসবে ব্যবহৃত দুটি ইনজেকশন ‘ম্যাগনেশিয়াম সালফেট’ ও ‘অক্সিটোসিন’ নেই গত পাঁচ মাস ধরে। এর মধ্যে ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ইনজেকশন একলাম্পসিয়া রোগে আক্রান্ত অন্তঃসত্ত্বাদের খিচুনি প্রতিরোধে এবং অক্সিটোসিন ইনজেকশন অন্তঃসত্ত্বার প্রসবের সময় জরায়ুর সংকোচন ঘটাতে, প্রসবের গতি বাড়াতে ও প্রসবের পর রক্তপাত বন্ধ করতে ব্যবহৃত হয়।
নেই আয়রন-ফলিক অ্যাসিড পিল। গত বছর জুন থেকেই এ উপকরণ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে অধিদপ্তর। এটি গর্ভাবস্থায় নারীদের জন্য ব্যবহৃত খাবার বড়ি। গর্ভে থাকা শিশুর শারীরিক ত্রুটি নিরসন করে। নেই অন্তঃসত্ত্বাদের গর্ভাবস্থায় ব্যবহৃত অ্যান্টিনেটাল কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন। গত এক বছর ধরেই এ উপকরণ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। দেরিতে প্রসবের ঝুঁকিতে থাকা মায়েদের প্রসবপূর্ব অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের অংশ হিসেবে এই ইনজেকশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি গর্ভে থাকা শিশুর শ্বাসকষ্ট ও শিশুমৃত্যু রোধ করে।
প্রসবসহ মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ তুলা (১০০ গ্রাম) এবং অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে ত্বক জীবাণুমুক্ত করতে ব্যবহৃত অ্যান্টিসেপটিক পোভিডোন আয়োডিন সলিউশন (বোতল) নেই এক বছরেরও বেশি সময় ধরে।
৮ উপকরণের মজুদ শূন্যপ্রায় : পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাপ্লাই চেইনের তথ্য অনুযায়ী, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ এড়াতে ব্যবহৃত উপকরণ এমআরএম (প্যাক) নেই ৪৫২ উপজেলা গুদামে। বাকি উপজেলায় যা আছে তা দিয়ে বড়জোর এক মাস চলবে।
স্যানিটারি ন্যাপকিন নেই ৪৫৫ উপজেলা গুদামে ও ১৪ উপজেলায় মজুদ শূন্যপ্রায়। অবশিষ্ট ৩৬ উপজেলায় যে পরিমাণ উপকরণ আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ দুই মাস চলবে। অধিদপ্তর ইতিমধ্যেই এর সরবরাহ মাসে আড়াই হাজারে নামিয়ে এনেছে। অথচ গত বছর মে মাসে ছয় হাজারের বেশি ও এ বছরের জানুয়ারিতে প্রায় ছয় হাজার উপকরণ সরবরাহ করেছিল। নারী-কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য ও নারীদের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব-পরবর্তী রক্তস্রাব বন্ধে এটি ব্যবহার করা হয়।
এমআর কিট নেই ৪৫৫ উপজেলা গুদামে আর ১৪ উপজেলার মজুদ শেষের দিকে। বাকি ৩০ উপজেলায় মজুদ উপকরণ দিয়ে সর্বোচ্চ দুই মাস চলবে। গত বছর ডিসেম্বরে ৪৭৬ কিট সরবরাহ করে অধিদপ্তর। পরে মজুদ কমে যাওয়ায় গত মাসে সরবরাহ নেমে আসে ১২৬ কিটে। অনাকাক্সিক্ষত গর্ভপাত ঘটাতে ব্যবহৃত এমআর কিট, দুটি ওষুধের সমন্বয়ে এক ধরনের চিকিৎসা।
অন্তঃসত্ত্বাদের ব্যাকটেরিয়াজনিত প্রদাহ রোধ করতে গর্ভাবস্থায় ব্যবহৃত জেন্টামাইসিন ইনজেকশন নেই ৪৪৬ উপজেলায় ও ১০ উপজেলায় মজুদ শেষের দিকে। বাকি ৩৯ উপজেলায় যে পরিমাণ ইনজেকশন আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ দুই মাস চলবে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ খাবার বড়ি সুখী (তৃতীয় প্রজন্ম) নেই ২৮৭ উপজেলা গুদামে ও ১২৭ উপজেলায় মজুদ শূন্যপ্রায়। বর্তমানে দেশের ৪০ শতাংশ সক্ষম দম্পতি এ পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। উপজেলা পর্যায়ে প্রতি মাসে এ উপকরণের চাহিদা ৬ মিলিয়ন সাইকেলের বেশি। বর্তমানে মজুদ আছে ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন সাইকেল। অর্থাৎ এই মজুদ দিয়ে আগামী এক মাসের মতো চলবে।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কনডমের সংকট ছিল। মাসে এর চাহিদা ৮০ লাখ। গত মে মাসে কিছু কেনায় এখন সংকট কিছুটা কেটেছে। তবে এখনো ২২ উপজেলা কনডমশূন্য ও ১৭৩ উপজেলায় মজুদ শূন্যের পথে।
ডিডিএস কিট নেই ৪ উপজেলায় ও ২৪৪ উপজেলায় শেষের দিকে। সে হিসাবে দেশের অর্ধেক উপজেলায় এই উপকরণ শূন্যে এসে ঠেকেছে। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা মা ও শিশুদের বিনামূল্যে ২২ রকম ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী দেওয়া হয়। এমন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী ডিডিএস কিট (ড্রাগ অ্যান্ড ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট কিট) নামে পরিচিত।
শিশু স্বাস্থ্যের এমএনপি (সাসেট) উপকরণ নেই ৩৬৮ উপজেলায়, ২৫ উপজেলায় মজুদ একেবারেই শেষের দিকে ও ১৬ উপজেলায় যে মজুদ তাও চাহিদা অনুপাতে অনেক কম। বাকি ৮৬ উপজেলায় যে পরিমাণ এমএনপি আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ দুই মাস চলবে। ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি পূরণে খাবারের সঙ্গে এ পাউডার মিশিয়ে খাওয়ানো হয়।
কারণ তদন্ত করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় : জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মজুদশূন্যতার কারণ তদন্ত করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এসব সামগ্রী কেনার জন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে দরপত্র কেলেঙ্কারির অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ মে দুদক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিবকে মজুদশূন্যতা এবং দরপত্র কেলেঙ্কারির অভিযোগ তদন্ত করতে বলেছে। পরে ৯ জুন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ একটি অফিস আদেশে বিভাগের চিকিৎসা শিক্ষা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকিকে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
এ ব্যাপারে মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘তদন্ত শুরু করেছি। যত দ্রুত সম্ভব কাজটা শেষ করব।’
আপনার মতামত লিখুন :