শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণের `অনুরোধ` বা `দাবি`টা যে আসবে তা একরকম জানাই ছিল। অবশেষে শেখ হাসিনার ভারতে পদার্পণের ঠিক চার মাস ১৮ দিনের মাথায় সেটা এলো! গত সপ্তাহে ২৩শে ডিসেম্বর সকালে দিল্লির চাণক্যপুরীতে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে সেই বার্তা `নোট ভার্বালে`র আকারে তুলে দেয়া হলো সাউথ বøকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টা বা নীতিনির্ধারকরা বেশ কিছুদিন ধরেই আকারে ইঙ্গিতে বা খোলাখুলি বলে আসছিলেন, তারা ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে তারা ফেরত চাইবেন, যাতে তাকে `গণহত্যা`র জন্য বিচারের কাঠগড়ায় তোলা যায়। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, আনুষ্ঠানিকভাবে সে বার্তা বা চিঠি কিন্তু দিল্লির কাছে পাঠানো হচ্ছিল না। অবশেষে সেটা যখন এলো, তখন তা এলো নোট ভার্বালের আকারে।
নোট ভার্বাল হলো আসলে দুই দেশের সরকারের মধ্যে এক ধরনের `ডিপ্লোম্যাটিক কমিউনিকেশন` বা কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যম – কিন্তু তাতে প্রেরকের কোনো স্বাক্ষর থাকে না। তবে, নোট ভার্বালের রীতি অনুযায়ী, ধরেই নেয়া যায় এ ক্ষেত্রেও বার্তাটি পাঠানো হয়েছে দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাসের লেটারহেডে এবং তাতে হাই কমিশনের রাবারস্ট্যাম্পও ছিল। বার্তাটি হাতে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিল্লির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে সেটির প্রাপ্তিস্বীকার করা হয়।তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এটাও জানিয়ে দেন, তাদের এ বিষয়ে এখনই কিছু বলার নেই!এরপর আরো কয়েকদিন কেটে গেলেও দিল্লির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া যেমন দেয়া হয়নি, তেমনি বাংলাদেশকে নোট ভার্বালের কোনো জবাবও পাঠায়নি ভারত। বস্তুত, ভারত সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিল্লিতে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলাকে আভাস দিয়েছেন,তারা এই অনুরোধকে আদৌ খুব একটা আমল দিচ্ছেন না।এমনকি,বাংলাদেশ সরকারও যে খুব একটা `সিরিয়াসনেস` বা গুরুত্বের সঙ্গে অনুরোধটা করেছে, সেটাও মনে করছেন না কর্মকর্তারা।তারপরেও এই বার্তার জবাব নিশ্চয় দেয়া হবে, কিন্তু তার জন্য দিল্লি কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো করবে না বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।কেন ভারত সরকার ওই নোট ভার্বাল নিয়ে এরকম মনোভাব পোষণ করছে, কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে তার কারণগুলোই অনুসন্ধান করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
`সাক্ষ্যপ্রমাণের ফিরিস্তি কোথায়?` বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকার যদিও দাবি করছে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর প্রচেষ্টাকে তারা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে ভারত কিন্তু মনে করছে তাদের পাঠানো বার্তা একটা `দায়সারা পদক্ষেপে`র চেয়ে বেশি কিছু নয়!
দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, সত্যিই যদি বাংলাদেশ এই ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস হত, তাহলে তো তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগগুলো কী এবং তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণই বা কী, সেই বিবরণও পেশ করত। মানে যেমনটা একটা চার্জশিটে থাকে! এক-দু`পাতার একটা নোটে যে সেটা থাকতে পারে না, তা তো বলাই বাহুল্য!
ফলে, তার বক্তব্য, বাংলাদেশ সরকার আসলে তাদের দেশের মানুষকে এটা দেখাতে চাইছে যে তারা ভারতের কাছে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়ে দিয়েছে এবং ফলে `বল এখন ভারতের কোর্টে – আমাদের এখন আর কিছু করার নেই!`
ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিবিদের কথায়, আমার তো মনে হচ্ছে যেন বাংলাদেশ এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যেন একটা বক্সে টিক দিয়ে দায়িত্ব সারলো আমাদের প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানোর কথা ছিল, জানিয়ে দিয়েছি – ব্যাস!
কিন্তু শেখ হাসিনাকে ভারত বিচারের জন্য হস্তান্তর করবে বাস্তবে এরকম সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই বাংলাদেশ হয়তো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়নি, এমনটাও ধারণা করছেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রকৃত কারণটা যাই হোক, নোট ভার্বালে যে যুক্তি দেখিয়ে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হয়েছে,(জুলাই-অগাস্ট গণহত্যার বিচারের জন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে) সেটাকে ভারত আসলে জোরালো কোনো দাবি বলে মনেই করছে না! কারণটা হলো কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া এ অভিযোগ জানানোর অর্থ এ বার্তার চরিত্র পুরোপুরি রাজনৈতিক।
এখন দু`দেশের প্রত্যর্পণ চুক্তিতেই পরিষ্কার বলা আছে রাজনৈতিক অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে হস্তান্তর করা যাবে না – ফলে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই সেই যুক্তিই প্রযোজ্য হবে, বলেন ওই কর্মকর্তা।
`লেটার রোগেটরি দিলে তবু না হয় বুঝতাম!`কোনো দেশের সঙ্গে ভারতের প্রত্যর্পণ চুক্তি বা বিশেষ কোনো ব্যবস্থা বা অ্যারেঞ্জমেন্ট থাকলে সেই দেশের কোনো নাগরিককে ভারত তাদের হাতে তুলে দিতে পারে – যদি তিনি একজন `ফিউজিটিভ ক্রিমিনাল` এফসি বা ফেরার আসামি হন। এখন কোন কোন শর্তের অধীনে ভারত একজন `এফসি`-কে তার নিজ দেশের হাতে তুলে দিতে পারে, তার নিয়মকানুন খুব স্পষ্ট – এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও তার পুরোটাই উল্লিখিত আছে।
এইসব রীতিনীতি কিছুটা নির্ভর করে বিশেষ ওই দেশের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তির বিশেষ ধারার ওপর। তবে মূল ধারাটা সব দেশের ক্ষেত্রেই এক, আর তা হলো যাকে ফেরত চাওয়া হচ্ছে তাকে কোনো `প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধে`র মামলায় ফেরার আসামি হতে হবে। এখন শেখ হাসিনা যখন ভারতে এসে নামেন, তখন তিনি কিন্তু কোনো ফেরার আসামি বা এফসি ছিলেন না।
ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী এ যুক্তি দেখিয়েই বলেন, মনে রাখতে হবে পাঁচই আগস্ট তারিখেও শেখ হাসিনার নামে সে দেশে কোনো মামলা ছিল না। ফলে ভারত যখন তাকে আতিথেয়তা দিচ্ছে, সেই মুহুর্তে তিনি কিন্তু কোনো ফেরার আসামি নন।
পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী আরো যুক্তি দিচ্ছেন,এখন শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর যদি তার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে শত শত মামলা একসঙ্গে দায়ের করা হতে থাকে,তাহলে এটা মনে করার যথেষ্ঠ কারণ থাকতে পারে এগুলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক যার ভিত্তিতে প্রত্যর্পণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে কি ধরেই নেয়া যেতে পারে, অনুরোধ যে আকারেই আসুক বা যতই জোরালো সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করা হোক ভারত কোনো অবস্থাতেই শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না?
জবাবে পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, না বিষয়টা ঠিক সেরকম নয়। যদি সব নিয়ম মেনে এবং আঁটঘাট বেঁধে ভারতের কাছে এই অনুরোধ জানানো হয়, তাহলে ভারত নিশ্চয়ই সেটা বিবেচনা করবে।
ঢাকায় ভারতের সাবেক এই হাই কমিশনারের ধারণা, এ ক্ষেত্রে একটি নোট ভার্বালের চেয়ে হয়তো অনেক বেশি কার্যকরী হত একটি `লেটার রোগেটরি`। ল্যাটিনে `রোগাটোরিয়াস` কথার অর্থ হলো তথ্য জানতে চাওয়া আর `লেটার রোগেটরি` হলো এক দেশের আদালত যখন অন্য দেশের আদালতের কাছে কোনো বিষয়ে আইনি সহায়তা চেয়ে চিঠি দেয়। সেটা কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হতে পারে, কিংবা আইনি প্রক্রিয়ায় সাহায্য করার অনুরোধ হতে পারে।
সুতরাং, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদালত বা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যদি ভারতের বিচার বিভাগের কাছে (সুপ্রিম কোর্ট) শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়তা চেয়ে কোনো চিঠি দিত (`লেটার রোগেটরি`) সেটার প্রভাব এই `দায়সারা` নোট ভার্বালের চেয়ে অনেক বেশি হত বলে ভারতের কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করছেন। তবে,এই ধরনের কোনো চিঠি পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট বিচার প্রক্রিয়াতেও যথেষ্ঠ অগ্রগতি হওয়া দরকার শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তা এখনো আদৌ হয়েছে কী না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে দিল্লির।
`আগে নিজেদের সেনাবাহিনীকে বলুন`বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন,শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধ ভারতের তেমন একটা আমল না-দেয়ার বড় কারণ হলো তার দেশ ছাড়ার পেছনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন। তারা বলছেন, শেখ হাসিনা যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর `প্রছন্ন সমর্থনে`ই নিরাপদে দেশ ছাড়তে পেরেছিলেন বা বলা যেতে পারে একটা `সেফ প্যাসেজ` পেয়েছিলেন তা এখন আর কোনো গোপন তথ্য নয়।
ভারতের শাসক দল বিজেপির ঘনিষ্ঠ পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ শুভ্রকমল দত্ত বলেন, ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার আগে আমি তো বলব মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের উচিত তাদের নিজেদের সেনাবাহিনীর কাছে জবাবদিহি চাওয়া, কেন তারা শেখ হাসিনাকে ভারতে যেতে দিলো।
বস্তুত, শেখ হাসিনা গত পাঁচই আগস্ট বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর একটি মিলিটারি এয়ারক্র্যাফটে করেই দিল্লির কাছে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে এসে অবতরণ করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর এর পরদিনই মানে ছয়ই আগস্ট পার্লামেন্টে জানান, শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি যাতে দিল্লিতে এসে নামতে পারে, তার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তরফে ভারতের কাছে আগাম অনুমতি বা `ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স`ও চাওয়া হয়েছিল। এবং সেই ঘটনার পর থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। তখনো বাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল ওয়াকার উজ জামান, এখনো তিনিই সেনাপ্রধান আছেন।
শুভ্রকমল বলেন, ফলে, যে পরিস্থিতিতেই শেখ হাসিনা ভারতে এসে থাকুন, তার পেছনে বাংলাদেশের বর্তমান সেনা নেতৃত্বের একটা সক্রিয় ভূমিকা অবশ্যই ছিল-যা অস্বীকার করা কঠিন। বাস্তবিক শেখ হাসিনা এখন আমাদের অতিথি হতে পারেন, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে -তাকে কিন্তু আমরা নিজে থেকে ডেকে আনিনি।
বস্তুত ভারত সরকারের কর্মকর্তারা এর আগে একাধিকবার মনে করিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়েই শেখ হাসিনা ভারতে এসেছেন,ভারত কিন্তু তাকে বিমান পাঠিয়ে `ইভ্যাকুয়াট` করেনি বা তুলে নিয়ে আসেনি। ফলে পাঁচই আগস্টের সেই ঘটনাক্রম আজ শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধকে বেশ কিছুটা দুর্বল করে দিচ্ছে বলেই ভারতের বিশ্বাস।
দিল্লিতে সাউথ বøকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, কারণ রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ (সেনাবাহিনী) তাকে ভারতে আসতে সাহায্য করেছে,আর এখন রাষ্ট্রেরই আর একটি স্তম্ভ (নির্বাহী বিভাগ) তাকে ভারত থেকে ফেরত চাইছে এর মধ্যে তো একটা স্ববিরোধিতা আছেই। এই সব কারণেই বাংলাদেশের নোট ভার্বালের তড়িঘড়ি একটা জবাব দেয়া উচিত কিংবা শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের ব্যাপারে দ্রæত একটা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত-তেমনটা ভারত মনে করছে না!
আপনার মতামত লিখুন :