মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের লাপাত্তা নেতাদের গল্প

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২৪, ০৯:১২ পিএম

আওয়ামী লীগের লাপাত্তা নেতাদের গল্প

পতনের আগে যারা বিদেশে গিয়েছিল তারা আর দেশে ফিরেনি। আর যারা পতনের পরে দেশেই লুকিয়েছিল তারা চুপিচুপি দেশ ছেড়েছেন। আর যারা ধরাখেয়েছে তারা গত ২ মাস আদালত-কারাগার আর রিমান্ডে সময় কাটছে। পালানোর গল্পটা সামনে আসছে কলকাতায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের লড়াচড়া দেখে। এরপর সামনে আসে নেতাদেও পালানোর নানা অবস্থানের তথ্য। কলকাতায় রাজারহাটের নতুন একটি শহর ‘নিউ টাউন’। সেখানের প্রায়য় ৪৮০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত অসাধারণ একটি স্থানের নাম কলকাতা ইকোপার্ক। সরকারি নাম প্রকৃতি তীর্থ। বাংলাদেশি পর্যটকদের কাছেও এই ইকো পার্ক বেশ জনপ্রিয়। সম্প্রতি সেখানে ঘুরতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক নাগরিক।
পার্কের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে করতে হঠাৎই তার চোখ আটকে যায় সেখানের একটি রেস্তোরাঁয় বসে থাকা দুই তিন জন ব্যক্তির উপর। মনে মনে বললেন,দেখে যেন মনে হয় চিনি উহাদের। এগিয়ে কাছাকাছি যেতে চিনেও ফেললেন। সেখানে বসে আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
নাহ,এটি কোন গল্প বা কল্পকাহিনী নয়। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দাবি করেছে, কলকাতার ইকো পার্কে তাদের ক্যামেরায় ধরা পড়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, অসীম কুমার উকিল, অপু উকিল ও হাজী সেলিমের এক ছেলেসহ আরও কয়েকজন।
প্রচারিত এক ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে, গত শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কলকাতার ইকো পার্কে বসে আড্ডা দিচ্ছেন একদা প্রভাবশালী আসাদুজ্জামান খান। মুখে শ্বেত শুভ্র সাদা দাড়ি। দূর থেকে দেখে চেনার উপায় নেই পাঁচ আগস্টের আগে তারই নির্দেশে সারাদেশে ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চলে।
ইকো পার্কে রাতে সাধারণত কলকাতার স্থানীয়রা আড্ডা দেয়ার সুযোগ পান। সাথে থাকে ডিনারেরও ব্যবস্থা। নিরাপদ ভেবে সেখানে বসেই আড্ডা দিচ্ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে আড্ডা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কিছু বাংলাদেশি জড়ো হওয়ায় দ্রæতই সটকে পরেন আসাদুজ্জামান ও তার সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরা।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধরতে দেশে চার দফা অভিযান চালালেও ব্যর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী। কিন্তু তাকে ধরতে না পারলেও এরই মধ্যে তার ছেলেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শুধু আসাদুজ্জামান খানই নন, আওয়ামী লীগের বহু প্রভাবশালী নেতা ও দলটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এখন লাপাত্তা।
বিভিন্ন সংবাদ ও গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,৫ আগস্ট মধ্যরাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যশোরের গুরুত্বপূর্ণ একটি নিরাপদ স্থানে নেয়া হয়। পরদিন তিনি বিশেষ প্রহরায় সীমান্ত অতিক্রম করেন বলে জানা গেছে। তবে এসব তথ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা যায়নি।
ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানকালে অন্যতম আলোচিত নাম ছিলেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত। তাকে আটকের খবর একবার চাউর হলেও, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কেউ এর সত্যতা নিশ্চিত করেননি। এরপরই নেট দুনিয়ায় তুমুল চর্চা- কোথায় আছেন উড়ে এসে জুড়ে বসা এই ব্যক্তি?
গেলো ৩০ আগস্ট গুলশান সোসাইটির নির্বাহী কমিটির সদস্য আরাফাত আশওয়াদ ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, আরাফাতকে সীমান্ত পার করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কাজে ঢাকা মহানগর উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের দুই-তিনজন কর্মকর্তা সহায়তা করছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশ বাহিনীকে আরাফাত উসকে দিয়েছেন দাবি করে আশওয়াদ ইসলাম বলেন, আন্দোলনের সময় আরাফাত একের পর এক বাজে মন্তব্য করেছেন। গুলি শেষ হবে না বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে উসকে দিয়েছেন। যার ফলে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অন্যতম আলোচিত চরিত্রের নাম ডক্টর হাছান মাহমুদ। হাসিনার কৃপা পেতে তার একমাত্র কাজই ছিলো বিএনপির সমালোচনা করা এবং দলটি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রæপ করা। এক সময় শোনা গেলো, হাছান মাহমুদকে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়েছে।
তবে এই খবরের সত্যতা মেলেনি। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে আসা এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে,ড.হাছান মাহমুদ সপরিবারে বেলজিয়ামে আছেন। তিনি একমাত্র ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে দেশটির লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে তার নিজের বাড়িতেই আছেন। সেখান থেকে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যোগাযোগও রাখছেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ রাজনীতিকদের মধ্যে যারা ভারতে যেতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এমপি শামীম ওসমান ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া।
গণমাধ্যমে আসা এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শামীম ওসমান আছেন দিল্লিতে এবং নওফেল ও বিপ্লব বড়–য়া পশ্চিমবঙ্গে বারাসাত এলাকায় অবস্থান করছেন। দালালদের সহায়তায় ৮ সেপ্টেম্বর নওফেল ও বিপ্লব বড়ুয়া ভারতে পৌঁছান। পরে তারা বারাসাত এলাকায় ভারতীয় নাগরিক জনৈক জুয়েলের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন।
কোথায় আছেন ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস? জানা গেছে, ‘দাম্ভিক’ হিসাবে খ্যাতি পাওয়া এই নেতা শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন চলার মধ্যেই গত তিন আগস্ট ভোরে অনেকটা গোপনে দেশ ছাড়েন। ওই দিন রাতে শেখ তাপস সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।
তাপসের বড়ভাই এবং আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ দেশে আছেন, না বিদেশে- এ নিয়ে সংগঠনের কারও কাছে তথ্য নেই। তবে জানা গেছে,তিনিও দেশে নেই। আন্দোলন চলাকালে কোনো এক সময় তিনি বিদেশে গেছেন। তার মতো অনেকেই একই পথ অনুসরণ করেছেন। মিডিয়ায় প্রকাশ পরশ কলকাতায় আছেছেন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম দেশ ছেড়ে যেতে পারেননি। তবে সাবেক এমপি শেখ হেলাল সরকার পতনের আগেই দেশ ছেড়েছেন। তিনি দেশ ছাড়লেও তার ছেলে বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সারহান নাসের তন্ময় দেশেই আত্মগোপনে আছেন।
শেখ হেলালের ভাই খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সালাউদ্দীন জুয়েলকে সরকার পতনের পর টুঙ্গিপাড়ায় দেখা গেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এরপর থেকে তিনি আত্মগোপনে। তিনি দেশে নাকি বিদেশে চলে গেছেন তা স্পষ্ট নয়। এনিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য দিতে পারেনি কোন পক্ষ।
জানা গেছে, ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম দেশ ছেড়ে যাননি। নিরাপদ স্থানেই অবস্থান নিয়েছেন। জনসমাগম বা সাধারণের সামনে আসছেন না। এড়িয়ে চলছেন সবাইকে, লোকচক্ষুর আড়ালে আছেন তিনি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়েও আসছেন না মেয়র আতিকুল।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গ্রেপ্তার হলেও চাঁদপুরের আরেক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন সূত্র বলছে, মায়া দেশেই কোথাও পালিয়ে আছেন। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য কারো কাছে নেই। ৩০ সেপ্টেম্বর দিবাগত রা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঝালকাঠি-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমু রাজধানী বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় অবস্থান করছেন সন্দেহে সেটি ঘিরে রেখেছিলেন শিক্ষার্থীরা। পরে ভবনটির ভেতরে ঢুকে কাউকে খুঁজে পায়নি তারা।
১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরের পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হতে শুরু করে,আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক এমপি জাহাঙ্গীর কবির নানক সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এরপরই মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সীমান্ত তল্লাশি অভিযানে নামে পুলিশ।
পরে পুলিশ জানায়, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশের একটি বিশেষ টিম জুড়ী ফুলতলা ইউনিয়নের বুটলী ও বিরইনতলা গ্রাম এলাকায় গিয়ে তল্লাশি চালায়। বিকেল পর্যন্ত এই তল্লাশি অভিযানে কারো ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন। দেশ ত্যাগ করেছেন সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও আন্দোলনের সময় স্বপরিবার সিঙ্গাপুরে চলে যান। সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ভারতে পালিয়ে গেছেন স্বপরিবারে। আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলামও ভারতে আছেন বলে জানা গেছে।
এছাড়া সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তাঁর মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার এবং ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীও দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।
এই তালিকায় আরও রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন (নিখিল), ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান)।
এ ছাড়া, বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিপ্লব কুমার সরকারও গেলো দশই সেপ্টেম্বর লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন বলে খবর বের হয়েছে। এমন আরও অনেকে এভাবে দেশ ছাড়ার চেষ্টায় আছেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের প্রায় দুই মাস পরও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরাও পড়েছেন কেউ কেউ। সীমান্ত পার হতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
পাঁচ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। তাঁর সঙ্গে দেশ ছাড়েন ছোট বোন শেখ রেহানা। জানা গেছে, শেখ হাসিনা তাঁর বোন রেহানা এবং মেয়ে সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলকে নিয়ে দিল্লির একটি নিরাপদ ভবনে বসবাস করছেন। আইনশৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন সুত্র জানায় পালিয়ে যাওয়াদের ধরতে শাড়াসি অভিযান চলছে।

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!