২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সঙ্কটের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা কিয়েভকে সক্রিয়ভাবে সমর্থিত দিয়ে আসছে। পশ্চিমাদের কৌশল হচ্ছে, রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না জড়িয়েছে মস্কোকে পরাজিত করা। এমন হাইব্রিড সংঘাতের দৃশ্যপট ওয়াশিংটনের জন্যও নতুন নয়। মধ্যপ্রাচ্যে তারা ইরানের বিরুদ্ধে হাইব্রিড সংঘাত ব্যবহার করে; চীনের বিরোধিতা করার জন্য তাইওয়ান এবং এই অঞ্চলে তার অন্যান্য অংশীদার-ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া,জাপানকে ব্যবহার করে।মস্কোকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পশ্চিম ইউরোপের মিত্ররাও একটি সুবিধাজনক হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছে ইউক্রেন। রাশিয়ার নিকটবর্তী একটি বৃহৎ রাষ্ট্র, যার বিশাল সেনাবাহিনী রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো সেখানে অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে। সামরিক উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষকও পাঠায়।
ইউক্রেনকে বিভিন্ন দুঃসাহসিক কাজের জন্য ব্যবহার করা হবে এবং তারপর যখন সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে, এটি পরিত্যক্ত হবে। কারণ তখন তারা অকেজো হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতি ইউক্রেনের নিজের ভবিষ্যতের অবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে এ বিষয়টি বর্তমান কিয়েভ সরকারের মাথায় আছে বলে মনে হচ্ছে না। পশ্চিমা সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে তারা কার্যত তার প্রকৃত জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে।
এ কারণে কিয়েভের কর্তৃপক্ষ সত্যিকারের যুদ্ধ নিষ্পত্তির দিকে পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম। তারা বিশ্বাস করে,যতক্ষণ যুদ্ধের ফ্রন্ট তারা ধরে থাকবে ততক্ষণ সঙ্কট অব্যাহত থাকতে পারে এবং তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুবিধাজনক সম্পর্কের সুবিধা নিতে পারবে। তবে আর নেতিবাচক দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে নিজের স্বার্থে কেবল ব্যয়যোগ্য সম্পদ হিসেবে দেখে।
হয় কিয়েভের সরকার বুঝতে পারছে না যে,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের স্বার্থ আলাদা এবং শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। অথবা তারা আটকা পড়েছে,কেননা তারা যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নিজেদের সমস্ত রাজনৈতিক মূলধন বাজি রেখেছে।
যখন একটি দেশ অন্য দেশের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন তার কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মের পরিণতির জন্য দায় বদ্ধতা মাথায় রাখে না। কেননা তারা জিতুক বা হারুক তাতে কিছু যায় আসে না। জিতলে তারা তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করবে, হেরে গেলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। চলমান সংঘাতের যদি কোনো সমাধান না হয়, তবে ইউক্রেন পূর্ব ইউরোপের একটি সামরিকায়ত `অস্থিতিশীল ছিটমহলে` পরিণত হওয়ার সম্ভাবনার মুখোমুখি হবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি যে,পশ্চিমা দেশগুলোতে ইউক্রেনের জন্য অনেক আশা রয়েছে। যদিও ইউক্রেনের পরাজয় অনিবার্য। এ কারণেই বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভকে নতুন অস্ত্র ব্যবহার বা তাজা সামরিক সরবরাহ কিংবা গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের কাহিনী সম্পর্কিত সংবাদগুলো কমে আসছে।
রাশিয়ার জন্য এই যুদ্ধটি সংবেদনশীল। তাদেরও আশঙ্কা আছে, নিজ দেশের মানুষ হতাহত হতে পারে। তবে সংঘাতের সামগ্রিক গতিপ্রকৃতি কিয়েভের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক। ইউক্রেনের নিজস্ব সম্পদ সীমিত। ইউক্রেনীয় এবং পশ্চিমা সূত্র অনুসারে, বর্তমানে যে সেনা বিভাগগুলো গঠিত হচ্ছে, সেগুলো পর্যাপ্ত আধুনিক সরঞ্জাম পাচ্ছে না। অপরদিকে,রুশ সৈন্যদের অগ্রগতির গতি দিন দিন বাড়ছে। তাই মস্কো এই সংঘর্ষে তার লক্ষ্য অর্জনে `অত্যধিক প্রচেষ্টা` চালাতে আগ্রহী নয়।
যদিও কৌশলগত পরবর্তী পরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট যদি ভেঙে যায়, তবে সংঘাতে ন্যাটো দেশগুলো সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে। তবে পশ্চিমের নেতারা বলছেন,যুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলোর সরাসরি জড়িত হওয়ার `কোনো ইচ্ছা নেই`।
ইউক্রেনের অনিবার্য পরাজয় যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তির জন্য একটি বড় আঘাত হবে। তাই ওয়াশিংটন এটি এড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাবে। সান জু,প্রাচীন চীনা গ্রন্থ `দ্য আর্ট অফ ওয়ার`-এর লেখক বলেছিলেন,যুদ্ধ তিন প্রকার: সর্বোত্তম বিকল্প হল প্রতিপক্ষের পরিকল্পনাকে পরাজিত করা, দ্বিতীয়টি হল তার জোটকে পরাজিত করা এবং তৃতীয়টি যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা। বর্তমান পর্যায়ে রাশিয়ার তিনটি মাত্রায় লড়াই করতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইউক্রেনের রণাঙ্গনে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না। নির্বাচনী চক্রের মাঝখানে ইউক্রেন নিয়ে কর্মকর্তাদের কথা বলার মতো সত্যিকারের কোনো সাফল্য নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল হচ্ছে, রাশিয়াকে এমন কিছু অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ নিতে চাপ দেওয়া, যা রাশিয়ার পরিকল্পনাকে বিপর্যস্ত করবে এবং রুশপন্থি জোটগুলোকে ধ্বংস করে দেবে। ওয়াশিংটন ক্রমাগত উত্তেজনা বাড়ানোর উপায় খুঁজবে এবং মস্কোকে উত্তেজনার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠাবে। তবে এই প্রেক্ষাপটেও আন্তর্জাতিক বিষয়ে রাশিয়া এখন যে শান্ত,দৃঢ় অবস্থান নিচ্ছে-তা আস্থা ও শক্তির বহিঃপ্রকাশ। এভাবেই রাশিয়া তাদের লক্ষ্য অর্জন করবে।
-লেখক: মস্কো-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও আলোচনা ফোরাম`ভালদাই ক্লাব`র প্রোগ্রাম ডিরেক্টর
আপনার মতামত লিখুন :