প্রতিবছর ২২ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ধরিত্রী দিবস। পৃথিবীর প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা ও মমত্ববোধকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের ধরিত্রী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আমাদের শক্তি, আমাদের পৃথিবী’জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস এবং নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করে। এটি এমন একটি বার্তা, যা কেবল পরিবেশবাদী আন্দোলনের জন্যই নয়, বরং আমাদের প্রতিদিনের জীবনের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রতপাদ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা যেভাবে শক্তি উৎপাদন ও ব্যবহার করি, তা-ই নির্ধারণ করছে আমাদের গ্রহের ভবিষ্যৎ। তাই, জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর প্রভাব রোধ করে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে যাত্রা করাই আজ সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের প্রধান ভুক্তভোগী দেশগুলোর একটি। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা- সব মিলিয়ে এখানে পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বেড়ে চলা জ্বালানি চাহিদা পূরণে এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বিরাজমান। দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশ এখনো গ্যাস, তেল ও কয়লার ওপর নির্ভরশীল। যদিও বাংলাদেশ নিজে মাত্র শুন্য দশমিক ৫ শতাংশেরও কম গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন করে, তবু এই পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব এখানেই সবচেয়ে বেশি পড়ছে। বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমণ ও বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ছে, যা দেশের প্রকৃতিক ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও কৃষি উৎপাদনে ব্যাঘাত-এসবই জলবায়ুর পরিবর্তিত আচরণের পরিণতি।
এমন পরিস্থিতিতে টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থায় রূপান্তর জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নবায়নযোগ্য উৎস যেমন সৌর, বায়ু ও জৈবজ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব বিকল্প গড়ে তোলা সম্ভব। তবে এ পরিবর্তন বাস্তবায়নে প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং কার্যকর নীতি সহায়তা। বাংলাদেশ যদিও বৈশ্বিকভাবে কম নিঃসরণকারী দেশ, তবুও জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তুলতে হলে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও আন্তঃখাত সমন্বয়ের ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সৌর শক্তি ও বায়ু শক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। দেশের উপকূলীয় অঞ্চল,চরাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকাগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প গ্রহণের অনুকূল অবস্থা বিরাজমান। গ্রামীণ সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই অনেক পরিবারে আলো পৌঁছে দিয়েছে। এই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আরও বৃহৎ পরিসরে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। শক্তির ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণই পারে গ্রহকে বাঁচাতে। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার কেবল পরিবেশ বান্ধব নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে এটি অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক ও টেকসই। সৌর, বায়ু, বায়োগ্যাস কিংবা জলবিদ্যুৎ—এই উৎসগুলো নির্বিচারে ব্যবহার করলেও তা প্রকৃতিকে ধ্বংস করে না। বরং, এগুলোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, স্থানীয় অর্থনীতি চাঙা হয় এবং জ্বালানিনির্ভরতা কমে।
বিশ্বজুড়ে এখন এক জীবাশ্ম জ্বালানি ফেজ আউটের জন্য বৈশ্বিক আন্দোলন চলছে। বাংলাদেশও জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরেছে এবং নিজস্ব অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছে। তবে অভিযোজনের পাশাপাশি এখন উৎপাদন কাঠামোয় রূপান্তর এর দিকে জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশ ২০২১ সালে “জাতীয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি” ঘোষণা করেছে, যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসবে বলে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজননবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য কর সুবিধা ও নীতিগত স্থায়িত্ব, সৌর প্যানেল উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রযুক্তি হস্তান্তর ও দক্ষ জনবল তৈরি, জাতীয় গ্রিডে নবায়নযোগ্য শক্তি সংযুক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি, সব সরকারি ভবনে বাধ্যতামূলকভাবে সৌর প্যানেল স্থাপন। তরুণ প্রজন্মকে এই খাতে উৎসাহিত করতে নবায়নযোগ্য প্রযুক্তি বিষয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা জরুরি।
ধরিত্রী দিবস কেবল সরকারের দায়িত্ব স্মরণ করায় না, বরং নাগরিকদের সচেতন ও কার্যকর ভূমিকার কথাও মনে করিয়ে দেয়। বিদ্যুৎ সাশ্রয়, পরিবেশবান্ধব জীবনধারা, এবং নবায়নযোগ্য পণ্যের ব্যবহার এগুলো ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের হাতিয়ার হতে পারে। বাড়িতে সৌর প্যানেল বসানো, এলইডি বাল্ব ব্যবহার, প্রয়োজনবোধে বিদ্যুৎ ব্যবহার সীমিত রাখা, ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার, ইলেকট্রিক বাইক ও গাড়ির ব্যবহার এ সবই পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দিকে ছোট ছোট পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যার তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ও সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পারি। পরিবেশ ক্লাব, তরুণ উদ্ভাবক, শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান মেলা, সামাজিক উদ্যোগ, এবং ক্লাইমেট ক্যাম্পেইন এসবের মাধ্যমে তরুণরা নেতৃত্ব দিতে পারে একটি ‘গ্রিন বাংলাদেশ’ গড়ার আন্দোলনে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে গ্রিন ক্যাম্পাস ইনিশিয়েটিভ, পরিবেশবান্ধব কারিকুলাম এবং সৌর বিদ্যুৎ চালিত ইকো ল্যাব গড়ে তোলার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনকে পরিবেশ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপ দেওয়া সম্ভব।
সরকার ইতঃমধ্যেই নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলের ব্যবহার বৃদ্ধি, বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। তবে, এই প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির প্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী করতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া জরুরি।
নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান। ভূমি স্বল্পতা, উচ্চ প্রাথমিক বিনিয়োগের খরচ এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব অন্যতম প্রধান বাধা। তবে, দীর্ঘমেয়াদী লাভের কথা বিবেচনা করলে এই চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ এবং উদ্ভাবনী সমাধান এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
"আমাদের শক্তি, আমাদের পৃথিবী" প্রতিপাদ্যটি কেবল নীতি নির্ধারক বা বিশেষজ্ঞদের জন্য নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি বার্তা বহন করে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার, সৌর প্যানেল স্থাপন, পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের সুবিধা সম্পর্কে অন্যদের জানানো এই সবই একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে আমাদের পদক্ষেপকে শক্তিশালী করতে পারে।
কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা এবং গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য একটি বড় হুমকি। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে সেচ ব্যবস্থা পরিচালনা, কৃষি যন্ত্রপাতি চালানো এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন করা গেলে একদিকে যেমন কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে, তেমনি অন্যদিকে কৃষকদের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হবে।
শিল্পক্ষেত্রেও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কলকারখানা এবং শিল্প ইউনিটগুলোতে সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে উৎপাদন খরচ কমানোর পাশাপাশি পরিবেশের ওপর চাপও হ্রাস করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা এবং বেসরকারি বিনিয়োগের সমন্বয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এবারের ধরিত্রী দিবসের বার্তাটি শুধু ধরিত্রী দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য নয়, বরং এটি এক আহ্বান নিজেদের শক্তিকে পরিবেশ রক্ষায় কাজে লাগানোর। জীবাশ্ম জ্বালানি আমাদের উন্নয়ন এনে দিয়েছে, কিন্তু তার মূল্য আমরা প্রকৃতি ও মানুষের স্বাস্থ্য দিয়ে দিচ্ছি। এখন সময় এসেছে টেকসই বিকল্প বেছে নেওয়ার। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে—আমরা কত দ্রæত ও কতটা পরিকল্পিতভাবে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে অগ্রসর হতে পারি তার ওপর। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ধাবিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং জনগণের সচেতনতাই পারে একটি টেকসই এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে।
ধরিত্রী বা পৃথিবী আমাদের একমাত্র আবাসস্থল। এর ভারসাম্য রক্ষা করতে কাজ করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। দিনদিন যেভাবে পরিবেশ দূষণ, বন নিধন, প্লাস্টিক বর্জ্য ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বাড়ছে, তাতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়াবহ পৃথিবী রেখে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে এবং ধরিত্রী রক্ষায় বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। এই লক্ষ্যে গাছ লাগানো, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহার, পানি-নদী ও প্রকৃতি সংরক্ষণে অংশ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের দিকে নজর দিতে হবে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র—সবার সম্মিলিত উদ্যোগই পারে ধরিত্রীকে রক্ষা করতে এবং এক টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে।
এই ধরিত্রী দিবস হোক একটি নতুন অঙ্গীকারের দিন। আসুন,এবারের ধরিত্রী দিবসে আমরা সকলে মিলে আমাদের গ্রহকে রক্ষা করার এবং নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর অঙ্গীকার করি। আমাদের সম্মিলিত শক্তিই গড়ে তুলবে আমাদের সবুজ পৃথিবী। আমাদের শক্তি, আমাদের ভবিষ্যৎ এবং অবশ্যই, আমাদের পৃথিবী।
লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
আপনার মতামত লিখুন :