বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ‘যাদের কথায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, আজকে তারাই আমাদের ভুলে গেছেন। বন্যার্তদের আগে আন্দোলনে আহতদের দেখার দরকার ছিল। এখনও হাসপাতালে আমার অনেক ভাই চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন। প্রশ্ন এখন কেন মারা যাবেন?’ উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অনুযোগের সুরে এ কথা বলেন মিরপুর বাঙলা কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র মোবারক হোসেন।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ীর মৃত কুদ্দুসের ছেলে তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে মিরপুর-১০ নম্বরে গত ১৯ জুলাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে গুরুতর আহত হন মোবারক। গুলিতে বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপর থেকে ভেঙে গেছে। আর ডান পায়ের পেশি ভেদ করে বেরিয়ে গেছে আরেকটি গুলি। দীর্ঘদিন রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গত ১২ অক্টোবর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ফিজিওথেরাপির জন্য ভর্তি হন তিনি। তাঁর মতো পুলিশের গুলিতে এমন গুরুতর আহতদের মধ্যে ১০ জনকে ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন চিকিৎসা দিচ্ছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন।
বাবা কুদ্দুস মিয়া মারা গেছেন অনেক আগেই। মা মায়া রানী ও ছোট বোন অযুফা আকতারকে নিয়ে কোনো রকমে চলে তাদের সংসার। ভালো চিকিৎসা পেলে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন মোবারক। তিনি বলেন, ‘আমার অপারেশন হয়েছে এক মাস পরে, একজন হাড় ভাঙা মানুষকে যদি এত দেরিতে অপারেশন করে, তাহলে কীভাবে সুস্থ হবে? রাতে যখন অপারেশন করা হাড়ে ব্যথা ওঠে, মনে হয় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছি। আমরা আন্দোলনে আহত হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছি, সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চাই না। চাই উন্নতমানের চিকিৎসা।’
মোবারকের দাবি, পঙ্গু হাসপাতালে এতদিন গণস্বাস্থ্যের মতো সেবা পেলে সুস্থ হয়ে যেতাম। তাঁর কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে শুধু উন্নত চিকিৎসার দাবি আহত ফুলের দোকান কর্মচারী মেহেদী আলমেরও। গত ১৮ জুলাই বাড্ডা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিজিবির গুলিতে আহত হন তিনি। মেহেদীর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে গুলি লাগে। ধাপে ধাপে এক থেকে দেড় বছর চিকিৎসা লাগবে তার।
গত মঙ্গলবার সরেজমিন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, আন্দোলনে আহতদের ফিজিওথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। সাত তলায় বেঞ্চের ওপর বসে দুই তরুণ মোবাইল গেমসে মগ্ন। তাদের মধ্যে এক তরুণ তানিমের হাঁটুর ওপর থেকে ডান পা কাটা। তাঁর বাঁ পাশে বসে আছেন পায়ে গুলিবিদ্ধ আবির হোসেন তালুকদার। পাশ দিয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে আসছেন আরেক তরুণ সালমান। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আন্দোলনে পুলিশের ছোড়া গুলি তাঁর পায়ে লেগেছে।
গত ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে বাঁ পা হারিয়েছেন নাদিম হোসেন। তিনি জানান, তাঁর বাবা দুলাল হোসেন একজন রিকশাচালক। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। নারায়ণগঞ্জে একটি কারাখানায় ৬ হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন। চিটাগাং রোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন তারা।
নাদিম বলেন, পরিবারের হাল ধরতে পড়ালেখা ছেড়েছি, আজকে দেশের জন্য নিজেই পরিবারের বোঝা হয়ে গেছি। আমার চাওয়া আন্দোলনে যারা হাত-পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে গেছে, তাদের জন্য সরকার স্থায়ী একটা কিছু করে দিক। যাতে বাকি জীবন সেটার ওপর ভর করে বাঁচতে পারি।
সাত তলার পাশেই একটি রুমে আহত ১০ জনের চিকিৎসা চলছে। তাদের সবাই পুলিশ ও বিজিবির গুলিতে আহত। সেখানে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন তিনজন নার্স। তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। আহতদের খাবার-দাবার থেকে শুরু করে ওষুধও দেওয়া হচ্ছে। সেখানে চিকিৎসা নেওয়াদের মধ্যে দু’জনের পা কেটে ফেলা হয়েছে। অন্য দু’জনের হাতে অস্ত্রোপচারের পর সক্রিয় করার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করানো হচ্ছে। এ ছাড়া বাকি ছয়জনের পা ভেঙে যাওয়ায় লোহার খাঁচা লাগিয়ে রাখা হয়েছে।
আহতদের দেখাশোনা ও সেবা করছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ফিজিওথেরাপি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাসিমা ইয়াসমিন। তাদের পুনর্বাসন জরুরি জানিয়ে তিনি বলেন,পঙ্গু হাসপাতালসহ সব হাসপাতাল থেকে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় তারা কোথায় যাবেন? আহত রোগীদের হয়তো হাত-পা জোড়া লাগবে; কিন্তু থেরাপির অভাবে সেটা ব্যবহার উপযোগী হবে না। সুত্র-সমকাল
আপনার মতামত লিখুন :