পরিচয় শেখ মুজিবের ভাগ্নে। এই পরিচয়েই তার পথচলা। সারাজীবন এমপি। এলাকায় দ্বিতীয় কোনো নেতা তৈরী হতে দেননী। এভাবেই তার জীবন চলছে অর্ধশত বছরেও বেশী সময় ধরে। তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিন ইউসুফ মারাগেলে কিছুদিনের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তাঁর ফুপাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় ফিরলেও আর মন্ত্রিত্ব পাননি। তবে টানা চারটি সংসদে ছিলেন ওই মন্ত্রনালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। মন্ত্রিত্ব না থাকলেও শেখ মুজিবের ভাগনে পরিচয় কাজে লাগিয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন সর্বত্র। স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, সড়ক পরিবহনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদারি কাজের বড় অংশই ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। বিশেষ করে বৃহত্তর ফরিদপুর, খুলনা, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের সব উন্নয়নকাজ নিজ হাতে ভাগবাঁটোয়ারা করতেন। বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিতেন মোটা অঙ্কের কমিশন। সম্প্রতি তার নমুনা মিলেছে শেখ সেলিমের বাসার ধ্বংসস্তুপে।
গত ৫ ফেব্রæয়ারি রাতে ঢাকার বনানীতে শেখ সেলিমের বাসায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। পরদিন সরেজমিন ঘুরে বাড়ির ভিতর ও আশপাশে বিভিন্ন সরঞ্জাম ও কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। এর মধ্য থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতে আসা একটি নথিতে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজের হিসাব পাওয়া গেছে। হাতে লেখা ২৪ পৃষ্ঠার সে নথিতে কাকে কোন কাজ দেওয়া হবে এবং সেখান থেকে কত টাকা কমিশন পাওয়া যাবে তা-ও উল্লেখ রয়েছে। এর সঙ্গে জাতীয় সংসদের একটি প্যাডে শেখ সেলিম ও তাঁর পরিবারের বেশ কিছু ব্যাংক হিসাব নম্বর লেখা রয়েছে। তবে এসব হিসাবে লেনদেন বা জমা টাকার পরিমাণ উল্লেখ নেই। প্যাডের আরেক পৃষ্ঠায় পরিবারের কয়েকজন সদস্যের পাসপোর্ট-সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে।
বনানীর বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ওই নথিতে গোপালগঞ্জের ১১টি, চুয়াডাঙ্গার একটি, হবিগঞ্জের একটি, টাঙ্গাইলের একটি, ময়মনসিংহের একটি, ফরিদপুরের একটি, নাটোরের একটি, খুলনার তিনটি এবং রাজশাহীর দুটি প্যাকেজের দরপত্রের বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ রয়েছে। কাগজের পাতায় পাতায় বিভিন্ন সংকেতের মাধ্যমে নির্বাচিত ঠিকাদার, কাজ শেষ করার সময় ও কমিশনের হার উল্লেখ রয়েছে। প্রাপ্ত কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সড়ক ও জনপথের কাজ থেকে শুরু করে স্টেডিয়াম নির্মাণ বা সংস্কার, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের উন্নয়নসহ সব রকম ঠিকাদারি কাজেই শেখ সেলিমের নিয়ন্ত্রণ ছিল।
নথিতে গোপালগঞ্জেরই ১১টি উন্নয়নকাজ ১১ প্যাকেজে ভাগ করে ঠিকাদার নির্ধারণ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব প্যাকেজে বাউন্ডারি ওয়াল, বিদ্যুতের সাব স্টেশন, গ্যালারি শেড, স্টেডিয়াম সংস্কার ও উন্নয়ন, হোস্টেল কাম অফিস ভবন, উইমেন স্পোর্টস কমপ্লেক্সে জিমনেসিয়াম, স্টেডিয়াম ও স্পোর্টস কমপ্লেক্সে গ্যালারি চেয়ার স্থাপনসহ নানা নির্মাণকাজের তথ্য রয়েছে নথিতে। রয়েছে দরপ্রস্তাব, দরপত্র দাখিলের বিভিন্ন তথ্য, বিভিন্ন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নাম ও তার পাশে বসানো টাকার অঙ্ক, নির্দিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নামের পাশে টিকচিহ্ন, প্রতিটি প্যাকেজের নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম লিখে পাশে বসানো হয়েছে টাকার অঙ্ক। কয়েকটি প্যাকেজে রেফারেন্স হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম লেখা রয়েছে।
প্রাপ্ত নথিতে গোপালগঞ্জ-১ প্যাকেজে সুইমিং পুল নির্মাণকাজের তথ্য রয়েছে। সেখানে বিএফএল/ এইচএলসি-জে/ ভি নামে ১২ কোটি ২৩ লাখ ৯৯ হাজার; কিউ এইচ মাসুদ অ্যান্ড কোং নামে ১১ কোটি ৬০ লাখ ৩৯ হাজার; মেসার্স আনাম ট্রেডার্সের নামে ১০ কোটি ২২ লাখ ৫৬ হাজার; এ, এস-এ এটকো- জে/ ভি নামে ৯ কোটি ৩৪ লাখ ৫৯ হাজার টাকার উল্লেখ আছে। নোটে সানু, এনাম ও ইউসুফ নামের পাশে ৮ লাখ টাকা লেখা আছে।
গোপালগঞ্জ প্যাকেজ-২-এ প্যাভিলিয়ন বিল্ডিং গ্যালারি নির্মাণে মার্কেন্টাইল করপোরেশনের পাশে ১১ কোটি ৬৭ লাখ ৬৩ হাজার, বিএফএল-এএলসিএল জে/ ভি নামে ১৩ কোটি ৮৯ লাখ ২০ হাজার, কিউ এইচ মাসুদ অ্যান্ড কোং নামে ১৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭৮ হাজার, মেসার্স আনাম ট্রেডার্সের নামে ১১ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার টাকার উল্লেখ আছে। মার্কেন্টাইলের নামের পাশে মাহবুব নাম উল্লেখ রয়েছে। নিচে পান্না-শিবু নামের পাশে ৫ লাখ লেখা আছে।
শেখ সেলিমের ওই নথিতে গোপালগঞ্জের বাইরে চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, হবিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও নাটোরের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ ভাগবাঁটোয়ারার প্রমাণও মিলেছে। শেখ সেলিমের হাতে লেখা নথিতে ফরিদপুর জেলা স্টেডিয়াম নির্মাণকাজের জন্য ১৩ ঠিকাদারের তালিকা রয়েছে। রাজশাহীতে উইমেন স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণের ঠিকাদারি তথ্য রয়েছে ওই নথিতে। সেখানে মোট ২০ প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। আরেকটি প্যাকেজে এ কমপ্লেক্সের সুইমিং পুল নির্মাণকাজের জন্যও ২০ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রস্তাবের তথ্য পাওয়া গেছে।
সরকারি কাজের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কাজের দরপ্রস্তাবের তথ্য গোপন থাকে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাইরে অন্য কারও এটি জানার কথা নয়। কিন্তু শেখ সেলিমের নথিতে প্রতিটি উন্নয়নকাজের জন্য দরপ্রস্তাব জমা দেওয়া ঠিকাদারদের আর্থিক প্রস্তাবের বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, যে কোনো কাজের দরপত্রের বিস্তারিত তথ্য শেখ সেলিম পেয়ে যেতেন। পরে তাঁর পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রভাবিত করতেন। এর বিনিময়ে তিনি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন নিতেন বলে জানা গেছে।
আপনার মতামত লিখুন :