বাংলাদেশে গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির বড় এবং মধ্যম সারির অনেক নেতা পালিয়ে ভারতে আসেন। তবে দলটির নেতারা বিষয়টিকে `সাময়িকভাবে আত্মগোপনে` থাকা হিসেবেই দেখছেন। অন্যদিকে দলটির প্রধান শেখ হাসিনাও অবস্থান করছেন ভারতে। ফলে কার্যত ভারতে বসেই আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের দলীয় কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে শুক্রবার (৭ ফেব্রæয়ারি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা।
বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে জানায়,শীতের সন্ধ্যা,কলকাতার উপকণ্ঠের এক রাস্তায় গাড়িতে কথা বলার জন্য বসেছিলাম আমি (বিবিসি বাংলার সাংবাদিক) আর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের এক সাবেক সদস্য। যাত্রাপথটা ছিল আধঘণ্টার একটু বেশি। তবে তার মধ্যেই অন্তত গোটা দশেক ফোন এলো তার। বেশিরভাগই বাংলাদেশে তার নির্বাচনী এলাকার আওয়ামী লীগ কর্মীদের কল। ওই সংসদ সদস্য তার নাম উল্লেখ করতে দিতে চাইলেন না।
গাড়িতে যেতে যেতেই আবার ভিডিও কলেও কথা বললেন তিনি কয়েকজনের সঙ্গে। ফেব্রæয়ারি থেকে বাংলাদেশব্যাপী নানা দলীয় কর্মসূচির ঘোষণা করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। ওই সাবেক সংসদ সদস্য দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন যে সেইসব কর্মসূচি কীভাবে পালন করতে হবে নিজের এলাকায়।
সেজন্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের যে কর্মীরা এখনো রয়ে গেছেন, তাদের মনোবল চাঙা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানালেন দলটির কয়েকজন নেতা।
কে কোথায় আছেন? আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ ভারতে পালিয়ে চলে আসেন। এটা এখন একটা `ওপেন সিক্রেট` অর্থাৎ সবারই জানা – অথচ কেউ তা খোলাখুলি বলেন না।
দলের যুগ্ম সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলছিলেন, ‘এটাকে ঠিক পালিয়ে আসা বলা যায় না। কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে আমরা আত্মগোপন করে আছি। এই অশুভ শক্তির একমাত্র লক্ষ্য তো আসলে আওয়ামী লীগ, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী মানুষ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করে, নিঃশেষ করে দেশত্যাগ করানো।’
আওয়ামী লীগের যেসব নেতা ভারতে অবস্থান করছেন,তাদের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গে আছেন। কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়, কেউ দিল্লিতে, কেউ আবার ত্রিপুরায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন বলে বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে। তবে ইউরোপসহ অন্যান্য দেশেও আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ অবস্থান করছেন। এদের কেউ ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরেই চলে এসেছেন ভারতে, কেউ আবার কয়েক মাস পরে এসেছেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে যে, প্রথম সারির বা `ক্যাটেগরি ১` নেতাদের মধ্যে অন্তত ২০০ জন পশ্চিমবঙ্গে বাস করছেন। এই শ্রেণির নেতাদের মধ্যে যেমন আছেন দল এবং সাবেক সরকারের শীর্ষ পদাধিকারী এবং মন্ত্রীরা, তেমনই আছেন প্রায় ৭০ জন সংসদ সদস্যও।
বাকিদের মধ্যে রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা,আওয়ামী লীগের অনেক জেলা সভাপতি-সম্পাদকরা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, মেয়র এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারাও।
‘এদের বেশিরভাগই নেতা। নেত্রী এবং নারী কর্মীরা খুবই কম আছেন এখানে। আবার অধিকাংশেরই পরিবার এখানে নেই,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন এক নেতা।
পশ্চিমবঙ্গে `ক্যাটেগরি ১` নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও উপজেলা স্তরের সভাপতি-সম্পাদক, জুনিয়র এবং কম গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতাদের সংখ্যাটা প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি বলে জানা যাচ্ছে। ভারতের বাইরে ইউরোপসহ বিশ্বের নানা দেশেই আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীরা আছেন।
যেভাবে দেশ ছেড়ে ভারতে-শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে কে কীভাবে বাংলাদেশ ছেড়েছেন, তা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিবিসির কাছে উল্লেখ করেছেন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। তবে তারা সেই যাত্রাপথ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে চাননি।
তবে ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সি ও গোয়েন্দা সূত্রগুলোর কাছ থেকে বিবিসি আগেই জানতে পেরেছিল যে, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়েই ৫ আগস্টের পরের কয়েকদিন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ভারতে এসেছিলেন। পেট্রাপোল বেনাপোলের মতো দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত চেকপোস্টগুলো কিছুটা এড়িয়েই চলা হয়েছে, কারণ ওই সীমান্তগুলো খুবই জনপ্রিয় এবং বহু মানুষের যাতায়াত থাকে সেগুলোতে।
আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ বলছিলেন, ‘আগস্টের ৫ তারিখের পরেই আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই। ফোনও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তবে আমি দেশেই ছিলাম। অক্টোবর মাসে আমি দেশ ছাড়ি। ঠিক কোন সীমান্ত দিয়ে আমি বেরিয়েছি, সেটা বলব না। কিন্তু পাহাড়, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ভীষণ কষ্টকর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আমাকে। কয়েকটা শহর ঘুরে বর্তমান স্থানে রয়েছি আমি।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম অবশ্য আগস্টের ১০ তারিখেই দেশ ছেড়েছেন, তার আগে কয়েকটা দিন তিনি দেশে আত্মগোপন করেছিলেন। তার কথায়,‘বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকে ভারতে আসতে সর্বোচ্চ কত সময় লাগতে পারে – আট, নয় ঘন্টা? আমার সময় লেগেছে দুই দিন – ১০ তারিখ রওনা হয়ে আমি সীমান্ত পেরোই ১১ তারিখ। খুব গোপনে সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছই আমি। তবে সেখানে আমাকে কেউ চিনে ফেলতে পারে, এই আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় অন্য এক সীমান্তে যেতে হয়। এই ভয়ও ছিল যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা তো আমাকে চেনে না – কাঁটাতারের বেড়া পেরোনোর সময়ে যদি গুলি চালিয়ে দেয়!’
এভাবেই নানা সময়ে আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতে বা অন্য কোনো দেশে `আত্মগোপন` করে রয়েছেন। ‘ইতিমধ্যে আমার মাতৃবিয়োগ হয়েছে ডিসেম্বরে। সারা জীবনের আক্ষেপ থেকে গেল যে দেশে গিয়ে মায়ের মুখাগ্নি করতে পারলাম না। আত্মগোপন করে থাকা অবস্থাতেই আমাকে মায়ের শ্রাদ্ধ শান্তি করতে হল,’ বলছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ।
ভারতে কেন? ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা দিল্লিতে আছেন ৫ অগাস্ট থেকে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি বিমান তাদের নিয়ে দিল্লির উপকণ্ঠে হিন্দোন বিমানঘাঁটিতে পৌঁছিয়ে দেয়। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে সব সময়েই একটা অভিযোগ উঠে এসেছে, তার সঙ্গে ভারতের বিশেষ সখ্যতা থেকেছে। তাই তিনি দেশত্যাগের পরে যে প্রথমে ভারতেই আসবেন, এটা কিছুটা স্বাভাবিক। তবে অন্য কোনো দেশে যে তিনি যাবেন না,দিল্লিতেই থেকে যাবেন আপাতত, এটা অনেকেই আন্দাজ করেননি হয়তো।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলছিলেন, ‘নেত্রী নিরুপায় হয়ে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন। একটা চক্রান্তকারী, অশুভ শক্তি তাকে ভারতে যেতে বাধ্য করে। আবার ভারতই আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং বন্ধু রাষ্ট্র। খুব কম সময়ে আমাদের দেশ থেকে এখানে এসে বসবাস করা যায়।’
‘তবে এই তো প্রথমবার নয়, সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়েও তো লাখ লাখ মানুষ আমাদের দেশ থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন উদ্বাস্তু হয়ে। দীর্ঘদিন তাদের খাদ্য,বাসস্থান, চিকিৎসা সব কিছুরই ব্যবস্থা করেছিল এই দেশ। তাই রাজনৈতিক কারণে দেশ ছাড়তে হলে ভারত স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম পছন্দ সেটা যেকোনো দলের জন্য প্রযোজ্য,’ বলছিলেন নাছিম।
যেভাবে নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ-ভারত এবং অন্যান্য দেশে যে সব আওয়ামী লীগ নেতা আত্মগোপন করে আছেন, তাদের মূল যোগাযোগের মাধ্যম এখন হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামের মতো নানা ডিজিটাল মাধ্যম। তবে যারা কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় আছেন, নিয়মিতই তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয় – একে অন্যের বাসায় যান। আর সারা বিশ্বে এবং বাংলাদেশে কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ হয় মূলত ডিজিটাল মাধ্যমে, জানাচ্ছেন আত্মগোপনে থাকা একাধিক নেতা।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘আজকের ডিজিটাল যুগে কে কোথায় থাকল, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ডিজিটাল যোগাযোগ এতটাই উন্নত হয়ে গেছে যে, একই সঙ্গে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়।’তিনি বেলজিয়ামে বসবাস করছেন বলে জানা গেলেও বাংলাদেশ থেকে তিনি সেদেশে কীভাবে গেলেন, তা জানা যায়নি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘শুধু তো আমাদের দলীয় নেতাকর্মী নন, এমন বহু মানুষ – যারা মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, প্রগতিশীল ভাবনায় বিশ্বাসী তাদেরকেও তো মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে। আমাদের নেতাদের কথা তো ছেড়েই দিন, কত যে মিথ্যা মামলা দিয়েছে আমাদের নামে, এখন আর তার খোঁজও রাখি আমরা। দলের কর্মীরা যারা দেশে আছেন, তাদের তো আওয়ামী লীগ পরিচয় দেওয়ারও অধিকার কেড়ে নিয়েছে এই অবৈধ, অসাংবিধানিক সরকার!’
আত্মগোপনে থাকা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে যে ফেসবুক,হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রামে অনেক গ্রুপ তৈরি হয়েছে নানা স্তরে যোগাযোগ রক্ষার জন্য। উপজেলা, জেলা ভিত্তিক এবং জাতীয় স্তরে, সহযোগী সংগঠনগুলোর নানা স্তরে যেমন গ্রæপ আছে, তেমনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক-বিহীন এরকম নামেও গ্রæপ রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের নেতা-কর্মীরা যেমন পোস্ট করছেন, তেমনই নানা নির্দেশ যাচ্ছে `আত্মগোপনে` থাকা নেতৃত্বের তরফ থেকে।
ওই গ্রæপগুলোতে নিয়মিত `ভয়েস চ্যাট`ও হয়, মতামত বিনিময় করেন নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ, সেসব কেমনভাবে চলছে বাংলাদেশের নানা এলাকায়, সেই সব ছবি–ভিডিও ওই গ্রæপগুলোতে নিয়মিত শেয়ার করা হচ্ছে বলে জানতে পেরেছে বিবিসি বাংলা।
আবার কোন এলাকায় কোন আওয়ামী লীগ নেতার ওপরে হামলা হলো বা কাকে গ্রেফতার করল পুলিশ, সেই সব তথ্যও গ্রæপগুলোতে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন আত্মগোপনকারী কয়েকজন নেতা।
আত্মগোপনকারী সাবেক সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ বলছিলেন, ‘হতে পারে আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড আছি, ডিজিটাল মাধ্যমেই কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বাধ্য হচ্ছি,কর্মসূচি ঘোষণা করতে হচ্ছে ফেসবুকে। কিন্তু এই ফেসবুকে কর্মসূচি ঘোষণা করাতেই তো অবৈধ সরকারের পা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে দেখি!’
শেখ হাসিনার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ? আওয়ামী লীগের যে কয়েকজন নেতার সঙ্গে বিবিসি বাংলা কথা বলতে পেরেছে, তারা সকলেই বলেছেন যে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তবে তাদের মধ্যে কারও সঙ্গে শেখ হাসিনার দেখা হয়েছে কী না, তা জানা যায়নি।
আত্মগোপনকারী নেতারা বিবিসিকে বলেছেন, তিনি নিয়মিতই নেতা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে সাধারণ কর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেন। একজন নেতা বলছিলেন, শেখ হাসিনাকে অ্যাপের মাধ্যমে মেসেজ করে রাখলে তিনি তার সময়-মতো উত্তর দেন। আবার নানা সময়ে তাকে ফেসবুক লাইভে আসতেও দেখা গেছে। বিভিন্ন হোয়াটস্অ্যাপ গ্রæপেও তিনি যোগ দিয়ে নানা নির্দেশ দেন বা বক্তব্য তুলে ধরেন। তবে এখনো পর্যন্ত শেখ হাসিনা যত ভাষণ দিয়েছেন,তার সবই অডিওতে। ৫ আগস্টের পর থেকে তার ভিডিও এখনো দেখা যায়নি। সূত্র: বিবিসি বাংলা
আপনার মতামত লিখুন :