দেশে ত্রয়োদশ নির্বাচনের সময় নিয়ে ‘স্পষ্ট’ হওয়ার জন্য বিএনপি যেদিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করল, সেদিনই জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলল, মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন দিলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। বিএনপি যেখানে ন্যূনতম বা জরুরি সংস্কার করে দ্রæত নির্বাচনের পক্ষে, সেখানে ‘মৌলিক পরিবর্তন’ বলতে এনসিপি কী বোঝাতে চাচ্ছে, সেই আলোচনাও সামনে এসেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের গঠিত দলটির নেতারা বলছেন, মৌলিক পরিবর্তন বা সংস্কার মানে হচ্ছে ক্ষমতার ভারসাম্য।বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষমতাকাঠামো এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এ ব্যবস্থা সংবিধানের মাধ্যমে সমর্থিত হওয়ার কারণেই শেখ হাসিনার সরকার ‘ফ্যাসিবাদী’ হয়ে উঠতে পেরেছিল। ফলে কোনো বড় রাজনৈতিক দল যদি রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোকেন্দ্রিক সংস্কারের বিরোধিতা করে অন্য সব সংস্কারে রাজিও হয়, তাতে দেশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে না।
ন্যূনতম সংস্কার বলতে কিছু নেই। সংস্কার মানেই মৌলিক গুণগত পরিবর্তন। মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে সবাইকে একমত হতে হবে।নাহিদ ইসলাম, আহ্বায়ক,এনসিপিমৌলিক সংস্কার বলতে এনসিপির শীর্ষ নেতারা অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর কিছু প্রস্তাবের কথা বলছেন। প্রস্তাবই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার সঙ্গে যুক্ত। এগুলো হলো প্রধানমন্ত্রীর একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হওয়ার সুযোগ বন্ধ করা, একজন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ দুবার দায়িত্ব পালনের সুযোগ, সাংবিধানিক বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী, সরকারি দল ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিসহ জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে নিম্নকক্ষে সংসদীয় আসন ও উচ্চকক্ষ আনুপাতিক ভোটভিত্তিক নির্বাচনের ব্যবস্থা এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার।
অবশ্য গত ২৮ ফেব্রæয়ারি এনসিপির আত্মপ্রকাশের দিন থেকেই সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলে আসছেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তবে মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য চান। নাহিদ ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ন্যূনতম সংস্কার বলতে কিছু নেই। সংস্কার মানেই মৌলিক গুণগত পরিবর্তন। মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে সবাইকে একমত হতে হবে।
এনসিপির নেতারা যেসব সংস্কার প্রস্তাবের কথা বলছেন, সেগুলোর মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কারের ক্ষেত্রে বিএনপি নীতিগতভাবে একমত। যদিও দলটি মনে করে, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ করার বিষয়ে একটি নির্বাচিত সংসদে বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা আছে।
মৌলিক সংস্কার বলতে এনসিপির শীর্ষ নেতারা অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর কিছু প্রস্তাবের কথা বলছেন। সব প্রস্তাবই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার সঙ্গে যুক্তবিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। দলটি মনে করে, সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। সংবিধান সংশোধনের মতো সংস্কার পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে দলটি। নির্বাচনের পথনকশার বিষয়ে স্পষ্ট হতে গত ১৬ এপ্রিল বুধবার দুপুরে বিএনপির নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। বের হয়ে ‘আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারিনি’ বলে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ওই দিনই বিকেলে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা মৌলিক সংস্কার নিয়ে কাজ করছেন। কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে, সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সে নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি না, সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে। তবে এনসিপির নেতারা এও মনে করেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি সবচেয়ে বড় দল।অন্তর্র্বতী সরকারও বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিএনপির মতামতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে বিএনপি যেসব প্রস্তাবে আপত্তি জানাবে, সেগুলোর বাস্তবায়ন কঠিন।
জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে এনসিপির আলাদা করে কোনো অভ্যন্তরীণ আলোচনা বা ঐকমত্য হয়নি। আমরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনা করে যাচ্ছি।এনসিপির সংস্কার সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক সারোয়ার তুষার প্রথম আলোকে বলেন,বর্তমান ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও ব্যবস্থা জন্য যে সংস্কার প্রয়োজন, সেটাই মৌলিক সংস্কার; যার মাধ্যমে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে ক্ষমতা কাঠামোকেন্দ্রিক সংস্কারের বিরোাধিতা করে অন্য সব সংস্কারে রাজি হয়েও লাভ নেই, সেটা মৌলিক সংস্কার হবে না।
এদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য যে কমিশনগুলো প্রতিবেদন দিয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সংস্কারটা অন্তর্র্বতী সরকারের সময়ই অধ্যাদেশের মাধ্যমে শুরু হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।তিনি বলেন, ক্ষমতাকাঠামোর ভারসাম্যের জন্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য গণপরিষদ নির্বাচন দরকার।মৌলিক সংস্কার না হলে ছাত্র–জনতার আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থেকে যাবে উল্লেখ করে আখতার বলেন, এনসিপি মনে করে,রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমাধান হওয়াটাই শ্রেয়তর। তাঁরা সরকারের কাছে সংস্কারের পথনকশা ও জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান করার দাবি জানাচ্ছেন বারবার।
এনসিপির মতো মৌলিক সংস্কারের কথা বলছে জামায়াতে ইসলামীও।সর্বশেষ বৃহস্পতিবার দলটির আমির শফিকুর রহমান নির্বাচনের জন্য যে তিন দাবি বা শর্তের কথা বলেছেন, এর প্রথমটি হলো ‘দৃশ্যমান ও গ্রহণযোগ্য মৌলিক সংস্কার’।আখতার বলেন, এনসিপি মনে করে,রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমাধান হওয়াটাই শ্রেয়তর। তাঁরা সরকারের কাছে সংস্কারের পথনকশা ও জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান করার দাবি জানাচ্ছেন বারবার।একই দিন এক বিবৃতিতে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন আয়োজন না করার আহ্বান জানিয়েছে।অপর দিকে বিএনপি শুরু থেকে বলে আসছে, সংস্কারের বিষয়ে ন্যূনতম যে ঐকমত্য তৈরি হবে, সেটার ওপর ভিত্তি করে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে।
বিএনপির সঙ্গে স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি হলেও এনসিপির অবস্থানের সঙ্গে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের অবস্থানের অনেকটা মিল রয়েছে। এ বিষয়ে এনসিপির নেতা সারোয়ার তুষার সাংবাদিকদের বলেন,জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে এনসিপির আলাদা করে কোনো অভ্যন্তরীণ আলোচনা বা ঐকমত্য হয়নি। আমরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনা করে যাচ্ছি।সারোয়ার তুষার বলেন, এনসিপি শুরু থেকে যে অবস্থানে ছিল, এখনো সেই অবস্থানে আছে। তাদের চাওয়া জুলাই আন্দোলনে হত্যার বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচন। অন্যান্য অনেক দল আগামী রোজার আগে নির্বাচন কিংবা ডিসেম্বরে নির্বাচন চাচ্ছে। তারা বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী সংবিধানের অধীনই সংসদ নির্বাচন বোঝাচ্ছে। এনসিপি বলছে, বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী সংবিধান বাতিল করে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে।তবে সবারই একই সুর ফ্যাসিবা স্বৈরাচার হাসিনার বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়। বিএনপি বলছে নির্বাচিতরা সংস্কার করবে। বিচার প্রক্রিয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া, সংস্কারও তাই।
আপনার মতামত লিখুন :