ইংরেজি বছর ২০২৪, দরজায় কড়া নাড়ছে ২০২৫ সাল। আন্তর্জাতিক ফুটবলে এই বছর ঘটে গেছে তোলপাড় ফেলে দেওয়া নানা ঘটনা, মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে অনেক কিছুর। কেউ ভেসেছে সাফল্যের জোয়ারে, কেউ কেঁদেছে ব্যর্থতার গøানিতে। সেই ঘটনাগুলো নিয়েই এই আয়োজন। বিগত কয়েক বছরের ধারা বজায় রেখে ফুটবলে আর্জেন্টিনার সাফল্য ও ব্রাজিলের ব্যর্থতা এই বছরেও দেখা গেছে। আবারও কোপা আমেরিকা জয়ের সাফল্যে ভেসেছে লিওনেল স্কালোনির দল। দলের প্রাণভোমরা মেসিকে ছাড়াও যে আর্জেন্টিনা সাফল্য দেখাতে পারে সেটাও দেখা গেছে এ বছর। লাউতারো মার্তিনেসের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে কোপার শিরোপা ধরে রাখে তারা। ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় দল হিসেবে জিতেছে মহাদেশীয় শিরোপা (২০২১)-বিশ্বকাপ (২০২২) ও মহাদেশীয় শিরোপা (২০২৪)।
অন্যদিকে,ব্রাজিলের গল্প ছিল ব্যর্থতায় মোড়ানো। মেসিদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া টুর্নামেন্টে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে ব্রাজিলকে। বিশ্বকাপ বাছাইয়েও খুব একটা সুবিধাজনক স্থানে নেই তারা। ১২ ম্যাচে ৫ জয় আর তিন ড্রয়ে ১৮ পয়েন্ট নিয়ে আছে পাঁচে। এরই মধ্েয হেরেছে চার ম্যাচ। কোচ বদলালেও ভাগ্য বদলাতে পারেনি সেলেসাওরা। দলের মূল তারকা নেইমার জুনিয়র ইনজুরির কারণে বেশিরভাগ সময়ই ছিলেন মাঠের বাইরে। ভিনিসিউস জুনিয়র,রদ্রিগো,রাফিনিয়ারা ক্লাব ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনার হয়ে আলো ছড়ালেও হলুদ জার্সিতে ছিলেন ম্রিয়মান।
ফিরেছে স্পেনের সোনালি সময়-২০০৮ থেকে ২০১২; স্পেনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন আন্দ্রেস ইনিয়ো-জাভি হার্নান্দেজ-ইকার ক্যাসিয়াসরা। ২০০৮ সালের ইউরো জয়ের পর ২০১০ সালে দলটি প্রথমবারের মতো জেতে বিশ্বকাপ। ইউরোর পরের আসরে আবারও চ্যাম্পিয়ন ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলের এই দেশটি। ক্লাব ফুটবলেও ইউরোপের মধ্যে দাপট দেখিয়েছে স্পেনের বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদ।তবে এরপর থেকে সাফল্যে ভাটা পড়ে স্প্যানিশদের।
হারানো রাজত্ব স্পেন ফিরে পায় ২০২৪ সালে। ইংল্যান্ডকে হতাশায় ডুবিয়ে দীর্ঘ এক যুগ পর ইউরোর শিরোপা উঁচিয়ে ধরেন লামিনে ইয়ামাল-নিকো উইলিয়ামসরা। টুর্নামেন্টজুড়ে ১৭ বছরের ইয়ামালের পারফরম্যান্স ছিল ঈর্ষণীয়। নতুন যুগের মেসি খ্যাতি পাওয়া এই ফুটবলার হয়েছেন ইউরোর সেরা উদীয়মান খেলোয়ার তকমা। অলিম্পিক ফুটবলেও সোনার হাসি হেসেছে লা রোহারা। সবমিলিয়ে স্পেনের স্বর্ণযুগ ফিরেছে বলাই যায়।
ক্লাব ফুটবলেও স্প্যানিয়ার্ডদের দাপট ছিল ২০২৪ সালে। মেয়েদের ফুটবলে ইউরোপসেরার মুকুট পরেছে বার্সেলোনা। আসরের সেরা খেলোয়ারের হন আইতানা বোনমাতি। পরে বর্ষসেরা নারী ফুটবলার পুরস্কারও জেতেন তিনি। ফিফার বর্ষসেরা পুরুষ ফুটবলারও হন স্পেনের রদ্রি। ইউরোর সেরা ফুটবলারও হয়েছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির এই স্প্যানিশ মিডফিল্ডার। পুরুষদের চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপাও জেতে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ।
ভিনিসিউসের ব্যালন ডি’অর না পাওয়া এবং দুই রোনালদোর বক্তব্য-২০২৪ সালে ফ্রান্স ফুটবল কর্তৃক বর্ষসেরার পুরস্কার ব্যালন ডি’অর উঠেছে ম্যানচেস্টার স্প্যানিশ খেলোয়াড় রদ্রির হাতে। যদিও পুরস্কার ঘোষণার আগে বেশিরভাগ মানুষই ধরে নিয়েছিলেন, ব্যালন ডি’অর জিততে যাচ্ছেন রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড ভিনিসিউস জুনিয়র। নিজেদের ক্লাবের ফুটবলারের না জেতার ঘটনা কয়েক ঘণ্টা আগেই জানতে পারে রিয়াল মাদ্রিদ। তাইতো বড়সড় বহর নিয়ে প্যারিসের জন্য তৈরি থাকলেও সেখানে যায়নি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের ক্লাব। । তাই এবারের ব্যালন ডি’অর পুরস্কার নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার পর তৈরি হওয়া সেই বিতর্কে পরে ঘি ঢেলে দিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার রোনালদো নাজারিও। ভিনিসিউসের পূর্বসূরী রোনালদো মনে করেন, এবারের ব্যালন ডি’অরটা প্রাপ্য ছিল ভিনিসিউসের। ২ বারের ব্যালন ডি’অর জয়ী রোনালদো বলেন, আমার মতটা পরিষ্কার। রদ্রিকে ছোট না করেই বলছি, ভিনিসিউসের ব্যালন ডি’অর জেতা উচিত ছিল। তাকে বিশ্বসেরার মুকুট পরানোর দারুণ একটা সুযোগ আমরা হারালাম।’
ব্রাজিলের রোনালদোর মতোই কথা বলেছেন আরেক রোনালদো। পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো মনে করেন এই পুরস্কার ভিনিসিউসের হাতে না ওঠা অন্যায্যতা,নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে এখন ভিনিসিউস, (জুডে) বেলিংহাম, লামিন (ইয়ামাল) খুব ভালো করছে। আমার মতে গোল্ডেন বল ভিনির প্রাপ্য ছিল। এখানে সবার সামনেই বলছি, এটা অন্যায্য হয়েছে।’
সবশেষ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা, উয়েফা সুপার কাপ ও স্প্যানিশ সুপার কাপ; এই ৪টি শিরোপা জিতেছেন ভিনিসিউস জুনিয়র। এতগুলো শিরোপা জয়ের পথে ক্লাবের হয়ে এই ফরোয়ার্ড করেছিলেন ২৪ গোল ও ১১ অ্যাসিস্ট। শেষ পর্যন্ত পুরস্কারটি তার হাতে ওঠেনি। জাগালো ও কাইজারের বিদায়ে ফুটবলবিশ্বে শোক
বছরের শুরুতেই ইহলোক ত্যাগ করেন ফুটবলে কাইজার বা সম্রাট হিসেবে পরিচিত ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। তার বিদায়ে ফুটবলবিশ্বে নেমে আসে শোকের ছায়া। আশি-নব্বইয়ের দশকে পেলে-ম্যারাডোনার সঙ্গে সেরা ফুটবলারের তালিকায় আসত বেকেনবাওয়ারের নামও। তার জাদুময় স্পর্শেই টানা তিনবার করে ইউরোপিয়ান কাপ (চ্যাম্পিয়নস লিগ) ও বুন্দেসলিগা জেতে বায়ার্ন মিউনিখ। খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপজয়ী মাত্র তিন ফুটবলারের একজন এই কাইজার। দিদিয়ের দেশম ও মারিও জাগালো বাকি দুই।
এই মারিও জাগালোও মারা গেছেন বছরের শুরুতে। ১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ফাইনালে নিজে গোল দেওয়ার পাশাপাশি পেলেকে গোল করতে সাহায্যও করেছেন। ১৯৭০ সালে ডাগআউটে থেকে ব্রাজিলকে আরেকটি বিশ্বকাপ জিততে সাহায্য করেন।
রিয়ালের শ্রেষ্ঠত্ব আর লেভারকুসেনের স্বপ্নযাত্রা-ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের আসন এ বছরে আরও পোক্ত করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। স্প্যানিশ সুপার কাপ জয়ের পর তারা নিজেদের ক্যাবিনেটে ভরে ২০২৪ সালের লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি। পরে উয়েফা সুপার কাপ এবং ফিফা কন্টিনেন্টাল কাপও জিতে নেয় লস ব্লাঙ্কোসরা। এবারের শিরোপাসহ চ্যাম্পিয়নস লিগ মোট ১৫ বার জয় করল রিয়াল। সাদা জার্সিধারীদের আশেপাশেও নেই অন্য কোনো ক্লাব। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭টি শিরোপা এসি মিলানের।
এ বছরই এক স্বপ্নময় যাত্রা দেখিয়েছে বায়ার লেভারকুসেন। টানা ৫১ ম্যাচ অজেয় থাকে তারা। শেষ পর্যন্ত আতালান্তার বিপক্ষে ইউরোপা লিগের ফাইনাল ম্যাচে হেরে থামে তারা। প্রথম দল হিসেবে তারা অপরাজিত থেকে শেষ করে জার্মান বুন্দেসলিগা। প্রথমবার বুন্দেসলিগা জেতা লেভারকুসেন ৩৪ ম্যাচ খেলে ২৮টি জিতেছে। এছাড়া ড্র করেছে ৬টি ম্যাচ। ইউরোপের প্রথম সারির কোনও লিগে এমন নজির নেই।
আপনার মতামত লিখুন :