মঙ্গলবার, ০৪ মার্চ, ২০২৫, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে ইউক্রেনকে ইউরোপ বাঁচাতে পারবে?

বিশ্ব ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ৪, ২০২৫, ১২:৫২ এএম

যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে ইউক্রেনকে ইউরোপ বাঁচাতে পারবে?

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বাগ্বিতন্ডার ঘটনা এখন বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে। এমন প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়ার আশা কমে এলেও ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। তবে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইউক্রেনকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ইউরোপ দিতে পারবে কি না,উঠছে সেই প্রশ্নও। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ও এনডিটিভি বলছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের জন্য ‘কৃতজ্ঞতা’ না থাকা এবং ‘নিঃশর্ত শান্তি পরিকল্পনার বিরোধিতা করায়’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স প্রকাশ্যেই ‘তিরস্কার’ করেছেন জেলেনস্কিকে।
ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে না, বরং ইউরোপের সামরিক বাহিনীকে এই দায়িত্ব নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে, রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধের জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছালে শান্তিরক্ষী হিসেবে ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার।কিন্তু মার্কিন সমর্থন ছাড়া কি ইউরোপ অর্থবহভাবে ইউক্রেনকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে? ইউরোপের প্রকৃত নিরাপত্তা সক্ষমতা কী? এই অঞ্চলটি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর কতটা নির্ভরশীল? 
ইউরোপীয় নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের ভূমিকা পালন করে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় নিরাপত্তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, যখন তারা পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো তৈরিতে সহায়তা এবং সোভিয়েত প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ইউরোপে লাখ লাখ সেনা মোতায়েন করেছিল। তখন থেকেই এই নিরাপত্তা নেতৃত্ব বজায় রেখেছে ওয়াশিংটন, একই সাথে নিজেদের ‘বৈশ্বিক পরাশক্তির’ মর্যাদাও প্রসারিত করছে।
মার্কিন সরকারের প্রতিরক্ষা জনশক্তি ডেটা সেন্টারের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬৫ হাজার সক্রিয়-কর্তব্যরত সৈন্য ইউরোপজুড়ে স্থায়ীভাবে মোতায়েন ছিল। তাদের কাছে বিস্তৃত অস্ত্রশস্ত্র, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য সম্পদ ছিল, যা ন্যাটোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও পালাক্রমে মোতায়েন করা প্রায় ১০ হাজার সৈন্য রয়েছে পোল্যান্ডে- যা রাশিয়ার সাথে ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 
সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করতে প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪ সালেও দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ৮৬০ বিলিয়ন ডলার, যা ন্যাটোর অন্যান্য সম্মিলিত সদস্যদের দ্বিগুণেরও বেশি।একই সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর থেকে দেশটিকে বেশিরভাগ সরাসরি সামরিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ট্রাম্প বলেছেন,এখন সময় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপ থেকে সামরিকভাবে সরে আসার। তিনি চান, মহাদেশে তার মিত্ররা এ বিষয়ে আরও বেশি পদক্ষেপ নিক।
ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্ররা কতটা শক্তিশালী?ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সম্মিলিতভাবে ২০ লাখ সক্রিয় সৈন্য রয়েছে, যাদের একটি ছোট অংশ সরাসরি জোটের কমান্ডের অধীনে কাজ করার জন্য নিযুক্ত।ন্যাটোর সবশেষ হিসাব অনুসারে, তুরস্ক এবং পোল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি সৈন্য রয়েছে যথাক্রমে ৪ লাখ ৮১ হাজার এবং ২ লাখ ১৬ হাজার।
ফ্রান্স এবং জার্মানির অনুপাত অনুযায়ী ২ লাখ ৫ হাজার এবং ১ লাখ ৮৬ হাজার সৈন্য রয়েছে। সম্ভাব্য শান্তি চুক্তির আওতায় ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব দেয়া যুক্তরাজ্যের ১ লাখ ৩৮ হাজার সৈন্য রয়েছে। 
এছাড়া পূর্বাঞ্চলে-এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, পোল্যান্ড, ¯েøাভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়াজুড়ে ন্যাটোর নিজের প্রায় ৪০ হাজার সৈন্য রয়েছে। 
গেøাবাল ফায়ারপাওয়ার প্রতিরক্ষা সূচক অনুসারে, ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্রদের সম্মিলিতভাবে প্রায় ৭ হাজার বিমান, ৬ হাজার ৮০০ ট্যাঙ্ক,২ হাজার ১৭০টি সামরিক জাহাজ এবং ছয়টি বিমানবাহী বাহন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা কমালে ন্যাটোর কী হউেল্লেখযোগ্য সামরিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, ন্যাটো এখনও ইউরোপে হুমকি প্রতিরোধের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।অর্থনৈতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রæগেলের মতে, নিজেদের কোনো সদস্যের ওপর বড় ধরনের আক্রমণের ক্ষেত্রে (রাশিয়ার মতো), ন্যাটো সম্ভবত আশা করবে যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে লাখ লাখ অতিরিক্ত সেনা পাঠাবে। 
তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি সেই অবস্থান থেকে সরে আসে, সেক্ষেত্রে ব্রæগেলের অনুমান, এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য ইউরোপকে ৫০টি নতুন ব্রিগেড তৈরি করতে হবে, যার প্রতিটিতে হাজার হাজার সৈন্য থাকবে। এরইমধ্যে, উদ্বিগ্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর চাপ অনুভব করছে।
ন্যাটোকে কীভাবে দেখে রাশিয়া?ন্যাটোর সম্প্রসারণকে শুরু থেকেই ইউক্রেন আক্রমণের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে আসছে রাশিয়া। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ১২ থেকে ৩২-এ উন্নীত হয়েছে এবং ক্রমাগত পূর্ব দিকে রাশিয়ার সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
বর্তমানে ছয়টি ন্যাটো সদস্য রাশিয়ার সীমান্তবর্তী, যার মধ্যে রয়েছে ফিনল্যান্ড, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া ও লিথুয়ানিয়া। পশ্চিমা সামরিক জোটটিকে দূরে রাখতে মস্কো দাবি করেছে, দীর্ঘদিন ধরে ন্যাটোর সদস্যপদ চেয়ে আসা ইউক্রেনকে যেন এই জোট থেকে দূরে রাখা হয়।কিন্তু রাশিয়ার আগ্রাসনকেই ন্যাটোকে শক্তিশালী করার কারণ হিসেবে দেখে পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো। 
রাশিয়ার সামরিক বাহিনী কতটা শক্তিশালী?বর্তমানে রাশিয়ার ১০ লাখের বেশি সক্রিয় সৈন্য রয়েছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ইউক্রেনে যুদ্ধ করছে বলে মনে করা হয়। মস্কো এর আগে ন্যাটো সদস্য পোল্যান্ড এবং লিথুয়ানিয়ার মধ্যে অবস্থিত তার পশ্চিমতম ছিটমহল কালিনিনগ্রাদে প্রায় ১২,০০০ সৈন্য মোতায়েন করেছিল। তবে,এই বাহিনীর বেশিরভাগই সংঘাতের আগে ইউক্রেনে পুনঃমোতায়েন করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
বিদেশেও সামরিক স্থাপনা পরিচালনা করে রাশিয়া, যার বেশিরভাগই সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে অবস্থিত। জর্জিয়ান ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত, বেলারুশে কমপক্ষে দুটি প্রধান ঘাঁটি, কাজাখস্তানে দুটি, আর্মেনিয়ায় দুটি, বিতর্কিত জর্জিয়ান অঞ্চল দক্ষিণ ওসেটিয়া ও আবখাজিয়ায় দুটি এবং কিরগিজস্তান,তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান ও মলদোভার বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল ট্রান্সনিস্ট্রিয়ায় একটি করে ঘাঁটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই স্থাপনাগুলোর মধ্যে বৃহত্তম হলো তাজিকিস্তানের দুশানবেতে অবস্থিত ২০১তম সামরিক ঘাঁটি,যেখানে ২০২২ সালের হিসাবে আনুমানিক ৭,০০০ রাশিয়ান সৈন্য ছিল। 
গেøাবাল ফায়ারপাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী,সামরিক সম্পদের দিক থেকে রাশিয়ার ৪,২৯২টি বিমান, ৫,৭৫০টি ট্যাঙ্ক, ৪৪৯টি সামরিক জাহাজ এবং একটি বিমানবাহী রণতরী রয়েছে।ন্যাটোর সম্মিলিত শক্তির তুলনায় রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা কম হলেও, ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র যদি পিছিয়ে যায়, তবে এটি ইউরোপের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা হবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।তবে শেষ কথা ট্রাম্প না চাইলে জেলেনেস্কি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না এটাই সত্য।
 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!