বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৬:৪৭ এএম, মে ৩১, ২০২১

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ

মাইক্রোগ্রামে (১ গ্রামের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ) ব্যবহার হওয়া ভয়ংকর মাদক এলএসডি শনাক্তে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে যে কোনো মূল্যে এ মাদকের মূলোৎপাটন করতে বদ্ধপরিকর তারা। এজন্য দফায় দফায় বৈঠক করছেন বাহিনীর কর্মকর্তারা। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। ইতোমধ্যে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে অর্ধশতাধিক সেবনকারী ও সরবরাহকারীকে। পাশাপাশি বেচাকেনায় ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ডার্ক ওয়েব ও কুরিয়ার সার্ভিসেও চোখ রয়েছে। এ মাদক শনাক্তে ডগ স্কোয়াড প্রস্তুত করবে এলিট ফোর্স র‌্যাব। ঢাকার অভিজাত এলাকাসহ সন্দেহভাজন এলাকাগুলোতে তৎপরতা বাড়িয়েছে পুলিশ। আর বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়কে ‘অ্যালার্ট’ থাকতে বলেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এমন তৎপরতার মধ্যে রোববার ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে এলএসডিসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে খিলগাঁও থানা পুলিশ। মাদকদ্রব্য উদ্ধার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ২০১৯ সালে দেশে প্রথমবারের মতো এলএসডি মাদক শনাক্ত হলেও তখন এটি নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয়নি। কিন্তু এবার এলএসডি সেবন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসেছেন। শুরুতেই এলএসডিকে সমূলে শেষ করতে কাজ করছেন তারা। যেহেতু এ মাদক গ্রহণকারীদের অধিকাংশই ধনী পরিবারের সন্তান তাই তাদের কীভাবে নজরদারির আওতায় আনা যায় সেটা নিয়ে চলছে আলাপ-আলোচনা। রোববার এ মাদক সেবনের পর গুলশানে একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীর সন্তান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। একটি সংস্থার মাদক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত এক বৈঠকে এ বিষয়টিও উঠে আসে। সাধারণত সড়কে দামি গাড়িগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশির আওতায় কম আসে। এক্ষেত্রে কী করা যায়- তা নিয়েও আলোচনা চলছে। জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার যুগান্তরকে বলেন, এ মাদকটি মাইক্রো লেভেলে আসছে। এটা যদি ইয়াবার মতো হতো বা অন্যান্য মাদকের বড় সাইজে বড় হতো তাহলে শনাক্ত করা সহজ হতো। এখন এটা শনাক্ত করা নতুন চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য। হয়তো এটার জন্য নতুন ইনস্ট্রুমেন্ট লাগবে। আমরা ডগ স্কোয়াডের কথা বলেছি। তিনি বলেন, ভয়ংকর এ মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা অত্যন্ত সতর্ক অবস্থানে আছি। বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়কে অ্যালার্ট থাকতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আজকেও (রোববার) মিটিং করে টেলিফোনে সবাইকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, কোনোভাবেই এ মাদককে ইয়াবার মতো বিস্তৃত হতে দেওয়া হবে না। এজন্য সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে থাকবেন তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, আমরা শুরুতেই বড় ধাক্কা দিতে চাই। কারণ যে কোনো মাদকের শুরুতেই বড় ধরনের ধাক্কা দিতে হবে- যাতে গ্রহণকারী, বিক্রয়কারী কেউ আর এটা নিয়ে চিন্তাও করতে না পারে। শুরুতেই ক্র্যাশ করতে না পারলে, একবার রাস্তা ওপেন হয়ে যায় এবং বিপণন সিস্টেম চালু হয়ে যায় তাহলে নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন। শুরুতেই সিস্টেম ভেঙে দেওয়া গেলে বিপণন বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা সেই বড় ধাক্কাটাই দিতে চাই। গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে আশা করছি সেটা করতে পারব। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আরও দুটো চক্র নিয়ে কাজ চলছে। এর গ্রহণকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি। এখন কাজ চলছে মূল চক্রটিকে ধরার। অনলাইনে বিশেষ নজরদারির পাশাপাশি নতুন মাদকটির ধরন বিবেচনায় নিয়ে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করছে র‌্যাব। এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে সংস্থাটির বিভিন্ন পর্যায়ে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে বলেন, করোনার এ সময়ে মাদক বেচাকেনায় অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো বেশি ব্যবহার হচ্ছে। ভয়ংকর এলএসডির ক্ষেত্রেও সেটিই দেখা যাচ্ছে। আমরা এর সরবরাহকারী ও গ্রহণকারীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা। যেহেতু এ মাদকটি এখনো সেভাবে পরিচিত নয় এবং এর ব্যবহার ও ধরনে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে, তাই এর মূলোৎপাটনেও কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ আছে। আমরা এক্ষেত্রে ডগ স্কোয়াডকে প্রস্তুত করব। যাতে এটি সহজেই শনাক্ত করা যায়। পাশাপাশি অনলাইনেও চলবে নজরদারি। উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর সন্তাদের বিশেষ নজরদারির আওতায় আনা হবে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য যা যা করণীয় সবই করব। তিন শিক্ষার্থীর ৫ দিনের রিমান্ড : এদিকে রাজধানীর একটি বাসা থেকে এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড) মাদক জব্দের মামলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর ৫ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। রোববার শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহর ভার্চুয়াল আদালত রিমান্ডের এ আদেশ দেন। রিমান্ডে যাওয়া আসামিরা হলেন- নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদমান সাকিব (রূপল) ও আসহাব ওয়াদুদ (তুর্য) ও ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আদিন আশরাফ। ২৭ মে ধানমন্ডি থানায় করা এ মামলায় তিন আসামির ৭ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সালাহউদ্দিন কাদের। ওইদিন আদালত আসামিদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়ে রোববার রিমান্ড শুনানির জন্য ধার্য করেন। আদালতে এদিন আসামিদের হাজির করা হয়নি। কারাগার থেকে তাদের ভার্চুয়ালি উপস্থিত দেখানো হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এর বিরোধিতা করা হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড আদেশ দেন। ডিবি বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তারা এলএসডি মাদকের সন্ধান পান। ২৬ মে রাতে রাজধানীর একটি বাসা থেকে এলএসডি জব্দ করে ডিবি পুলিশ। এরপর এলএসডি বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছে পাওয়া যায় ২০০ পিস এলএসডি। আরও ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার : রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এলএসডিসহ ৫ জন গ্রেফতার হয়েছে। রোববার ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের খিলগাঁও থানা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলো- সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফ (২০), এসএম মনোয়ার আকিব ওরফে আনান (২০), নাজমুস সাকিব (২০), নাজমুল ইসলাম (২৪) ও বিএম সিরাজুস সালেকীন ওরফে তপু (২৪)। তাদের কাছ থেকে দুই হাজার মাইক্রোগ্রাম ওজনের ১২ পিস ব্লটার পেপার, এলএসডি বিক্রির নগদ ৪৬ হাজার টাকা, একশ মার্কিন ডলার, গাঁজা, মোবাইল ও ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত সবাই বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. আ. আহাদ জানান, গ্রেফতারকৃতরা এক বছর ধরে এলএসডি মাদক সেবন ও ব্যবসা করে আসছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনলাইনের মাধ্যমে এলএসডি কিনে কুরিয়ার ও বিভিন্ন ব্যাগেজের মাধ্যমে দেশে আনত। এলএসডি মাদক সেবন ও বিক্রির চক্রে আরও অনেক সদস্য রয়েছে। তাদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা চৌদ্দ-পনেরটি এলএসডি মাদক সেবন ও বিক্রির গ্রুপের সন্ধান পেয়েছি। যে পাঁচজন থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা এলএসডি মাদক সেবনের পাশাপাশি ব্যবসা করত। আমরা অন্য গ্রুপগুলোকে শনাক্ত ও গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। ডিসি আরও বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে সাইফ, আনান ও সাকিবকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় সাইফের কাছ থেকে এলএসডি মিশ্রিত তিন পিস ব্লটার পেপার, আকিবের কাছ থেকে এক পিস ব্লটার পেপার, সাকিবের কাছ থেকে এক পিস ব্লটার পেপার উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে ভাটারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে নাজমুল ও তপুকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ছয়টি ব্লটার পেপার ও গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে।
Link copied!