কেয়ারটেকার পদে চাকরি নিয়েছিলেন। চাকুরির কয়েক মাসের মধ্যেই অনিয়মের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্তও হয়েছিলেন। শাস্তিমূলক বদলির পর আবার স্বপদে ফিরেছিলেন। কৃষি কলেজে তখনও উপ-সহকারি প্রকৌশলীর পদ সৃষ্টি হয়নি। তবুও ওই পদটি শূন্য দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। তদন্ত শেষে আবার তাকে ফেরানো হল সেই কেয়ারটেকার পদে। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই পদে যোগদান করলেন না। যা হবার তাই হল, চাকুরী থেকে দ্বিতীয় দফায় সাময়িক বরখাস্ত হলেন। বিশেষ ক্ষমায় আবার ফিরে পেলেন কেয়ারটেকার পদ।
এরই মধ্যে কলেজ উন্নীত হল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার চাকুরিও স্থানান্তরিত হল। বিধি ভেঙে প্রশাসন থেকে প্রকৌশল শাখায় তার পদ ন্যাস্থ হল। কেয়ারটেকার থেকে এক লাফে তিনি হলেন শাখা কর্মকর্তা। এবার তাকে ঠেকায় কে?। সেখান থেকে পদোন্নতি পেয়ে সহকারি প্রকৗশলী হলেন। এবার তার নির্বাহী প্রকৌশলী হতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই পদ না থাকলেও তিনি ঠিকই পদন্নোতি পেয়ে যান। শুধু তাই নয়, তারপর রকেট গতিতে পর্যায়োন্নয়ন পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
এই ভাগ্যবান তিনি হচ্ছেন আমির হোসেন। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) প্রকৌশল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে কর্মরত আছেন। ২০০৩ সালে ছাত্র বিক্ষোভের মুখে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. একেএম আবদুল হান্নান ভুঁইয়া ঢাকা অবস্থান করছিলেন। ওই সময়ে বিলুপ্ত কৃষি কলেজ থেকে আমির হোসেনের চাকুরি বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মীকরণ করা হয়। যে স্মারক বলে আত্মীয়করণ করা হয়, তা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম কার্যত বন্ধ ছিল।
পবিপ্রবির অন্তত তিনজন অধ্যাপক, যারা বিভিন্ন মেয়াদে রেজিস্ট্রারের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন তাদের সঙ্গে আমির হোসেনের রকেট গতির পদোন্নতি নিয়ে আলাপ হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন, পদোন্নতির পেছনে অনৈতিক বিষয় জড়িয়ে আছে। সেই কারনে বিধি ভেঙে আমির হোসেনকে বারবার পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে চাকুরি জীবনে একজন সর্বোচ্চ দুইবার পর্যায়োন্নয়ন পেতে পারেন। কিন্তু আমির হোসেনের ক্ষেত্রে তার ব্যতয় ঘটেছে।
কলেজ থেকে শুরু
পটুয়াখালী কৃষি কলেজ তখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা প্রতিষ্ঠানে অধীনে ছিল। কৃষি গবেষনা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পেয়ে আমির হোসেন ১৯৮৭ সালে ১৫ জুলাই পটুয়াখালী কৃষি কলেজের কেয়ারটেকার পদে যোগদান করেন। যোগদানের কিছুদিন পরে অনিয়মের অভিযোগে রহমতপুর কৃষি গবেষনা কেন্দ্রে তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। এক পর্যায়ে অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় তিনি চাকুরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন। পরবর্তিতে ক্ষমা চেয়ে পুনরায় কৃষি কলেজের কেয়ারটেকার পদে চাকুরিতে পুন:বহাল হন।
১৯৯৫ সালের ২১ মে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে কেয়ারটেকারের দায়িত্বের সাথে উপ-সহকারি প্রকৌশলীর শূন্য পদের দায়িত্ব দেন। তৎকালীন সময় কলেজে উপ-সহকারি প্রকৌশলীর পদ না থাকায় তার অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্নে উঠে। কলেজে উপ-সহকারি প্রকৌশলীর কোন পদ শূন্য না থাকায় উক্ত দায়িত্ব থেকে আমির হোসেনকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ২০০২ সালের ১ অক্টোবরের সেই অফিস আদেশে বলা হয়, বিলুপ্ত কৃষি কলেজের পিপি মোতবেক আমির হোসেনের চাকুরি প্রশাসন শাখায় অন্তভুক্ত থাকায় এখন থেকে তিনি উক্ত শাখায় দায়িত্ব পালন করবেন।
ওই আদেশ অমান্য করে আমির হোসেন প্রকৌশল শাখায় থেকে যান। বিষয়টি কর্তৃপক্ষ অবগত হবার পর ওই বছরের ১৩ অক্টোবর পুনরায় আদেশে আমির হোসেনকে তিন দিনের মধ্যে প্রশাসন শাখায় স্বীয় কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে আমির হোসেন প্রশাসন শাখার কেয়ারটেকার পদে পুনরায় যোগদান করেন। আদেশ পালনে সময় ক্ষেপনের জন্য এরই মধ্যে তাকে কারন দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়। এমনকি তাকে চাকুরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয়।
হঠাৎ করেই পরবর্তি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি তার সাময়িক বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। শুধু তাই নয়, একই আদেশে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) বিধিমালা ১৯৮৫ এর ১৩ (২) ধারা মোতাবেক পূর্বের কেয়ারটেকার পদে পূর্ন:বহাল করা হয়। একই সাথে তাকে পূর্বের কর্মস্থল (প্রকৌশল শাখা) যোগদানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। মূলত এই আদেশের ফলে আমির হোসেনের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। বলতে গেলে রকেট গতির পর্যায়োন্নয়ন তৎকালীন উপাচার্যের সময় শুরু হয়।
আত্মীকরণ প্রশ্নবিদ্ধ
পটুয়াখালী কৃষি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হল। ২০০২ সালের ২৬ ফেব্রয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি হয়। পবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ড. এ কে এম আবদুল হান্নান ভুঁইয়া দায়িত্ব নেয়ার পর ২০০৩ সালের ডিসেম্বর ক্যাম্পাস জুড়ে তুমুল ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনের সময় উপাচার্য ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ থাকেন। পরে প্রশাসনের সহযোগিতায় তিনি ক্যাম্পাস ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। তখনো ঢাকা পবিপ্রবির লিয়াজোঁ অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়নি।
একদিকে ক্যাম্পাসজুড়ে তুমুল আন্দোলন চলছে, অপর দিকে আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাস ছেড়ে উপাচার্য ঢাকা অবস্থান করছেন। এমন পরিস্থিতিতে ২০০৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর পবিপ্রবি/প্রশা (রাজস্ব)/২০০৩/৮১৭ স্মারকের মাধ্যমে আমির হোসেনকে শাখা কর্মকর্তা (প্রকৌশল) হিসেবে চাকুরি আত্মীকরণ রা হয়। আন্দোলনের মুখে কার্যত ক্যাম্পাস অচল হয়ে পড়ে। তখন আত্মীীকরণের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাছাড়া আমির হোসেনের আত্মীকরণের যে স্মারক দেয়া হয়েছে, তা পবিপ্রবির সংস্থাপন শাখায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবুও থেমে থাকেনি আমির হোসেনের রকেট গতির পর্যায়োন্নয়ন। ২০০৬ সালের ১৮ অক্টোবর তিনি সহকারি প্রকৌশলী (পুর) পদে পর্যায়োন্নয়ন পান।
পদ নেই তবুও পদোন্নতি
তখনো পবিপ্রবি অর্গানোগ্রাম পরোপুরি তৈরী হয়নি। সহকারী প্রকৌশলীর পরবর্তি নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু তাতে কী? আমির হোসেনের পর্যায়োন্নয়েনর আর তর সইছে না। কারণ তিনি ইতোমধ্যেই বিএসসির সনদ জুগিয়ে ফেলেছেন। তাই ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর নির্বাহী প্রকৌশলীর সমমানের পদে আমির হোসেনকে পর্যায়োন্নয়নের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দেন। নির্বাহী প্রকৌশলীল পদ নেই তবুও পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমির হেসেন নিজেকে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পরিচয় দিতে গিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে হেনস্থা হচ্ছেন। কিন্তু ততেও তিনি থেমে থাকেননি।
শাখাওয়াত হোসেন উপাচার্যের দায়িত্ব নেয়ার পর আমির হোসেন তার পেছনে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েন। অনেকটা বাধ্য হয়ে শাখাওয়াত হোসেন ২০১১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পুনরায় পর্যায়োন্নন দেন। তবে সেই পর্যায়োন্নয়নের আদেশে শর্তও জুড়ে দেন। আদেশে বলেন, ‘নির্বাহী প্রকৌশলীর সমমানের পদ রিজেন্ট বোর্ডে রিপোর্টকরণ সাপেক্ষে সংশোধনী পূর্বক পদায়ন করা হল।’ পরবর্তীতে রিজেন্ট বোর্ডের সভায় আমির হোসেনকে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পর্যায়োন্নয়ন দেয়া হয়েছে কী-না? সেই তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তত্ত্বাবধায়ক থেকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী
আমির হোসেন বিলুপ্ত পটুয়াখালী কৃষি কলেজে তত্ত্বাবধায়ক মানে কেয়ারটেকার পদে চাকুরি নিয়েছিলেন। ধাপে ধাপে তিনি পর্যায়োন্নয়ন পেয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী হয়েছেন। উপাচার্য সামসুদ্দিনের সময় আবার তিনি পর্যায়োন্নয়ন পেয়েছেন। ২০১৬ সালের ১৩ জুন তিনি প্রকৌশল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) হিসেবে সর্বশেষ পর্যায়োন্নয়ন পেয়েছেন। আমির হোসেনের শিক্ষা সনদ জালের অভিযোগ ওঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে তাকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। সেই নোটিশে তার সম্পদের বিবরণ দাখিলের জন্যও বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ঠদের বক্তব্য
আমির হোসেন বলেন, বিধি অনুসরন করেই পর্যায়োন্নয়ন পেয়েছি। তাছাড়া চাকুরি জীবনে সাময়িক বরখাস্ত তেমন অপরাধ নয়। প্রশাসনিক আদেশ অমান্য করায় আমার বিরুদ্ধে সেই সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ নিয়েছিল।
অধ্যাপক ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের জেষ্ঠ অধ্যাপক। ছিলেন একাধিবার ডিন আর রেজিষ্ট্রারের দায়ুত্বে। এখনো আছেন উপাচার্যের রুটিন মাফিক দায়িত্বে। আরো আছেন রেজিস্ট্রারের অতিরিক্ত দায়িত্বে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি ঘেটে বলেছেন, কর্মকর্তাদের দুই বারের বেশি পর্যায়োন্নয়নের বিধান নেই। কিন্তু আমির হোসেনের বেলায় সেটি অনুসরন করা হয়নি। এটা যারা উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। এ ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই।