বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১

জাপা নেতা নাসিরসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার

প্রকাশিত: ০৮:১২ এএম, জুন ১৫, ২০২১

জাপা নেতা নাসিরসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার

চিত্রনায়িকা পরীমণি বনানীর বাসা থেকে গত ৮ জুন রাত সাড়ে ১১টার দিকে কস্টিউম ডিজাইনার জিমি, অমি, বনিসহ দুটি গাড়িতে চেপে উত্তরার দিকে যান। যাত্রাপথে অমি বলেন, বেড়িবাঁধে ঢাকা বোট ক্লাব লিমিটেডে তাঁর দুই মিনিটের কাজ আছে। তাঁর কথায়, ঢাকা বোট ক্লাবের সামনে রাত ১২টা ২০ মিনিটের দিকে গাড়ি দাঁড় করানোর পরই পরীমণির সঙ্গে ঘটে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার মতো ঘটনা। সাভার থানায় করা মামলায় এমনটাই উল্লেখ করেছেন পরীমণি। মামলার পর অভিযুক্ত জাতীয় পার্টির নেতা নাসির উদ্দিন মাহমুদ (৫০) ও তাঁর বন্ধু তুহিন সিদ্দিকী অমিসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাসির উত্তরা ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা বোট ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য (বিনোদন ও সংস্কৃতি)। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ১৩ নম্বর বাসা থেকে নাসিরসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গ্রেপ্তার অন্য তিনজন হলেন অমির বন্ধু স্নিগ্ধা ও নাসিরের সঙ্গী লিপি ও সুমি। এর আগে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গতকাল দুপুরে সাভার থানায় নাসিরসহ ছয়জনের নামে মামলা করেন পরীমণি। এতে নাসির ও তাঁর বন্ধু অমির নাম উল্লেখ করে আরো চারজনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়। এর আগে সকালে রূপনগর থানার মাধ্যমে লিখিত অভিযোগ করেন পরীমণি। গত ৮ জুন রাতে বোট ক্লাবেই নাসির ধর্ষণের চেষ্টা করেন বলে পরীমণি মামলায় অভিযোগ করেন। গত রবিবার রাতে প্রথমে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাসে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তুলে বিচার চান পরীমণি। ফেসবুক পেজে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ‘মা’ সম্বোধন করে সহায়তা চান। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাঁর বনানীর বাসায় সাংবাদিকদের কাছে নির্যাতনকারীদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেন পরীমণি। ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, ঢাকা জেলা পুলিশের একটি দল উত্তরায় নাসিরের বাসায় অভিযান চালায়। ওই দলটিকে সহায়তা করতে উত্তরা বিভাগের একটি দলও সেখানে গিয়েছিল। মামলার এজাহারে পরীমণি উল্লেখ করেন, গত ৮ জুন রাত ১২টা ২০ মিনিটের দিকে আমাদের গাড়ি ঢাকা বোট ক্লাবের সামনে এসে থামে, কিন্তু বোট ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অমি কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। তখন ক্লাবের সিকিউরিটি গার্ডরা গেট খুলে দেন। তখন অমি বলেন, এখানের পরিবেশ অনেক সুন্দর, তোমরা নামলে নামতে পারো। এজাহারে পরী আরো বলেন, ‘রাতে আমরা ক্লাবে প্রবেশ করে বারের কাছের টয়লেট ব্যবহার করি। টয়লেট থেকে বের হতেই নাসির উদ্দিন মাহমুদ আমাদের ডেকে বারের ভেতরে বসার অনুরোধ করে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেন। আমরা বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলে নাসির ও অমি মদপান করার জন্য জোর করেন। আমি মদপান করতে না চাইলে নাসির জোর করে আমার মুখে বোতল ঢুকিয়ে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। এতে আমার সামনের দাঁতে ও ঠোঁটে আঘাত লাগে। নাসির আমাকে গালাগাল করেন এবং শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ ও ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এ সময় নাসির উত্তেজিত হয়ে টেবিলে রাখা গ্লাস ও মদের বোতল ভাঙচুর করে আমার গায়ে ছুড়ে মারেন। তখন আমার কস্টিউম ডিজাইনার জিমি নাসিরকে বাধা দিতে চাইলে তাঁকেও মারধর করেন। আমি প্রথমে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দিতে গেলে আমার ব্যবহৃত ফোনটি ফেলে দেন। আবার ফোনটি উঠিয়ে কল দিতে চাইলে ফের ফোনটি টেনে ফেলে দেন।’ এজাহারে পরী আরো বলেন, ২ নম্বর আসামি অমিসহ অজ্ঞাতপরিচয় চারজন আসামি ১ নম্বর আসামিকে (নাসির) ঘটনা ঘটাতে সহায়তা করেন। নাসিরের বাসায় মিলল বিদেশি মদ-ইয়াবা, মাদক মামলার প্রস্তুতি : রাজধানীর উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডে গতকাল দুপুরে নাসিরকে গ্রেপ্তারের সময় বাসায় অভিযান চালিয়ে বিদেশি মদসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা বিভাগ (উত্তর-তেজগাঁও, গুলশান, মিরপুর ও উত্তরা) এবং সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘পরীমণির মামলার পরিপ্রেক্ষিতে নাসির উদ্দিন মাহমুদের বাসায় অভিযানকালে তাঁর বাসা থেকে বিদেশি মদসহ অন্য মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁর বাসায় উঠতি বয়সী নারীরা এসে মদ পান করতেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তাঁর বাসায় ডিজে পার্টির আয়োজন ছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করা হবে।’ হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘এটা (গ্রেপ্তারের সময়) পরীমণির কস্টিউম ডিজাইনার অমির বাসা। পরীমণির সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে নাসির তাঁর তিন নারী সঙ্গী নিয়ে এই বাসায় পালিয়ে ছিলেন। মাদক রাখার অভিযোগে সেই তিনজনকেও আমরা গ্রেপ্তার করেছি।’ অভিযুক্ত নাসিরের ব্যাপারে তিনি বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আগে মাদক ও নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে। নানা অভিযোগে তাঁকে উত্তরা ক্লাব থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। তবে পরীমণির দায়ের করা মামলায় আসামি নাসির ও অমিকে সাভার থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। মদের বোতল নিতে বাধা দেওয়ায় হামলা করেন পরীমণি—দাবি নাসির উদ্দিনের : পরীমণি ঢাকা বোট ক্লাবে তাঁকে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় গ্রেপ্তারের সময় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানান। তিনি বলেন, ‘যে ঘটনা বলা হচ্ছে, এ সবই মিথ্যা। আমি যখন বের হয়ে যাই তখন ওরা ঢোকে। ওরা যখন ঢোকে তখন আমাদের সিকিউরিটি অফিসাররা ছিলেন না। তারা মদ্যপ অবস্থায় ঢোকে। তাদের সঙ্গে একজন ছেলে ছিল। তারা মদ্যপ ছিল। তারা ঢুকে আমাদের বারের কাউন্টার থেকে বড় বড় দামি ড্রিংক জোর করে নেওয়ার চেষ্টা করে।’ আপনার বিরুদ্ধে কেন অভিযোগ—এমন প্রশ্নের জবাবে নাসির বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ড্রিংকসগুলো যে তারা নিতে চাইছে তারা তো নিতে পারেনি, তারা তো মেম্বার না। আমি জাস্ট তাদের বাধা দিয়েছি যে এটা নেওয়া যাবে না। নিতে হলে কোনো অ্যাকাউন্টের অ্যাগেইনস্টে নিতে হবে। এটা বিক্রিয়যোগ্য নয়।’ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এর পরই সে উত্তেজিত হয়ে যায়। এরপর সে ভাঙচুর ও গালাগাল করতে থাকে। আমাদের স্টাফরা তাকে থামানোর চেষ্টা করেন। ওই সময় আমি থামানোর চেষ্টা করি। তার সঙ্গে যে ছেলে ছিল সে ওই সময় এসে আমাকে চড়-থাপ্পড় দেয়। গ্লাস মারে আমার ঘাড়ে লাগে। আমাদের সিকিউরিটির লোকরা এসে তাকে সরিয়ে নেন। আপনারা সিসি ক্যামেরায় দেখবেন সে গাড়িতে কিভাবে উঠেছে।’ ঢাকা বোট ক্লাব থেকে নাসিরকে বহিষ্কার : ঢাকা বোট ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটি থেকে নাসির উদ্দিন মাহমুদকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে নাসির, তুহিন সিদ্দিকী অমি ও শাহ এস আলমের ক্লাবের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির এক ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমিটির সভাপতি ড. বেনজীর আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় কমিটির আরো আট সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠক থেকে পরীমণির অভিযোগ তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত লড়ব, দোষীদের আইন অনুযায়ী শাস্তি চাই—পরীমণি : গতকাল সোমবার রাতে পরীমণির বনানীর বাসায় তিনি সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় সাংবাদিকদের পাশে থাকায় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পরীমণি বলেন, ‘আপনারা আমার পাশে আছেন। এখন আমি ভয় পাচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত লড়ব, দোষীদের আইন অনুযায়ী শাস্তি চাই।’ এ সময় নাসিরের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ছিল কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে পরীমণি বলেন, ‘তাঁকে আমি জীবনেও দেখিনি। কোনো পরিচয়ও ছিল না।’ অমির বিষয়ে জানতে চাইলে পরীমণি বলেন, ‘জিমির মাধ্যমে অমির সঙ্গে পরিচয় হয়। সে ব্যবসা করে এতটুকুই জানতাম।’ নাসির তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন। এ বিষয়ে কী বলবেন, ‘এখন আর কী বলবে (নাসির), একটা কিছু তো বলা লাগে। তাই হয়তো বলেছে। তিনি যদি কিছু না করতেন, তাহলে কেন বিভিন্ন মাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছেন। আমাকে অভিযোগ না করতে অনেক কিছু বলা হয়েছে। বলেছে, তুমি নায়িকা, ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। আরো অনেক কিছু। কিন্তু নিজের বিরুদ্ধে যেটি ঘটেছে, সেটি বললে কেন অসম্মান হবে।’
Link copied!