বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

ডায়াবেটিস ও শরীরের রোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩০ এএম, নভেম্বর ১৪, ২০২০

ডায়াবেটিস ও শরীরের রোগ

‘ডায়াবেটিস সেবায় পার্থক্য গড়ে দেয় নার্সিং’-এ প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হচ্ছে। ডায়াবেটিস রোগীদের নার্সরা সহায়তা প্রদান করে থাকেন। ডায়াবেটিস রোগীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই নার্সদের ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। ২০১৯ সালে প্রতি ১১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল (মোট ৪২৫ মিলিয়ন); ২০৪৫ সালে তা ৪৮ শতাংশ বেড়ে ৬২৯ মিলিয়ন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পৃথিবীর মোট ডায়াবেটিসের রোগীর ৮৭ শতাংশই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বসবাস করছেন। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ এ বিশেষ দিনে অর্থাৎ ১৮৯১ সালের ১৪ নভেম্বর বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেন্টিং কানাডায় জন্মগ্রহণ করেন। বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেন্টিং এবং চার্লস বেস্ট ১৯২১ সালে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনসুলিন আবিষ্কার করেন। এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের মূল ভূমিকায় ছিলেন ফ্রেডরিক বেন্টিং। বিশ্বজুড়ে প্রতি ২ জন ডায়াবেটিসের রোগীর ১ জন রয়ে গেছে। গড়ে প্রতি ৬টি সন্তান প্রসবের ১টি মায়ের ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত। ২০১৬ সালে মানুষের স্বাস্থ্য খাতের মোট পৃথিবীর মানুষের স্বাস্থ্য খাতের মোট ব্যয়ের ১২ শতাংশের বেশি চিকিৎসার ব্যয় হলেও চার শতাংশের তিন শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী নিু অর্থবিত্তের দেশগুলোতে বসবাস করেন। ডায়াবেটিস যে পরিবারের ওপর গোত্রীয় প্রভাব বিস্তার করে এবং এর জন্য পরিবারের সব সদস্যের সহযোগিতা প্রয়োজন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রতি রোগীর পরিবারের সদস্যের অংশগ্রহণ জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শরীরের প্রায় প্রতিটি অংশের ক্ষতি করতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিডনি, হার্ট, চোখ, কান, ত্বক, স্নায়ুতন্ত্র, অস্থিসন্ধি এবং প্রজননতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত করে থাকে। ডায়াবেটিস শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। ডায়াবেটিসের জটিলতা হিসেবে কিডনি রোগ দেখা দিতে পারে। এর সার্বিক অর্থ হল- টাইপ-২ ডায়াবেটিস ব্রেনের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায় বা সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপের একই যোগসূত্র থাকতে পারে একটি হরমোনের সঙ্গে, যা অ্যালডোস্টেরন নামে পরিচিত। অ্যালডোস্টেরন উচ্চরক্তচাপ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। রক্তে অত্যধিক পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকলে ডায়াবেটিস রোগীদের হার্টের রোগ এবং রক্তনালির রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। সিনিয়রদের মধ্যে যাদের ডায়াবেটিস ও ডিমেনসিয়া রয়েছে, তাদের লো ব্লাড প্রেসার থেকে সৃষ্ট মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত রক্তের সুগার রক্তনালিকে ধ্বংস করে থাকে, যার ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস রোগীর রক্তনালি ধ্বংসের কারণে ডায়াবেটিস রোগীরা স্ট্রোকের ঝুঁকির মধ্যেও থাকে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণে যৌন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। ডায়াবেটিস যৌন অঙ্গগুলোর রক্তনালি এবং øায়ুর ক্ষতি করতে পারে। ফলে যৌন অনুভূতি কমে যেতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গের শুকনো ভাব ও যৌন কার্যক্রমে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ছেলেদের ক্ষেত্রে যৌন ক্ষমতা নিঃশেষ হওয়া ডায়াবেটিসের জটিলতা হিসেবে দেখা যায়। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এবং পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ পায়ের ক্ষতি করতে পারে। এনলার্জড প্রোস্টেট ওষুধ ডায়াবেটিস ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হওয়ার কারণে যারা ফিনাসটেরাইড গ্রুপের প্রোসকার এবং ডুটাসটেরাইড বা এভোডার্টজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে আসছেন, তাদের ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডায়েট সোডা পান করলে মারাত্মক ধরনের ডায়াবেটিস চক্ষু রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ডায়াবেটিস রোগী অন্ধ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে, যদি যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ না করে। এক গবেষণায় দেখা যায়, অল্প বয়সীদের মাঝে যাদের হৃদরোগ অথবা স্ট্রোকের সংক্রমণের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি তরুণদের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাই ব্লাড সুগারের কারণে শরীর থেকে ফ্লুইড কমে যেতে পারে এবং ত্বক শুষ্ক হয়ে যাবে। আপনার ত্বককে সুস্থ রাখতে প্রচুর পরিমাণে পানি এবং অন্যান্য পানীয় পান করুন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকলে ১০ মিনিট করে তিন ভাগে ব্যায়াম করলে ব্লাড সুগার লাগামহীনভাবে বেড়ে যাবে না এবং হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি কমে যায়। ডায়াবেটিস যেহেতু রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সেহেতু ডায়াবেটিস রোগীর মুখে বিভিন্ন ধরনের রোগ এবং সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। মুখের অনেক রোগ সহজে ভালো হতে চায় না। আবার মুখের রোগের চিকিৎসায় ডায়াবেটিস থাকার কারণে সব ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। ডায়াবেটিস রোগীদের অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মুখের যত্ন নিতে হবে। মুখে সামান্য সমস্যা হলেও আপনি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। ডায়াবেটিসের ওষুধ ছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ সেবনের কারণে আপনার মুখে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে মুখস্থ ওষুধ সেবন না করে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন। শারীরিক ব্যায়াম ডায়াবেটিসজনিত স্নায়ুর ব্যথার উন্নতি ঘটিয়ে থাকে। ব্যায়াম ডায়াবেটিসজনিত øায়ুর ক্ষতিকে ধীর করে দেয় অথবা বাধা প্রদান করে। অতএব ডায়াবেটিস রোগকে কোনোভাবেই অবহেলা করবেন না। সব সময় আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন। সুখী জীবনযাপন করুন। বাংলাদেশে যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম। কিন্তু আরও ভয়াবহ হল ২০৩০ ও ২০৪৫ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে থাকবে। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে উচ্চহারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে খুব দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক ও কাঙ্ক্ষিত হারের চেয়ে বেশি, মানুষের দৈহিক শ্রম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানসিক চাপ বেড়েছে অনেকগুণ। উন্নত দেশগুলোতে ডায়াবেটিস রোগীর হার কমলেও তবে তা খুব উল্লেখযোগ্য হারে নয়। অঞ্চলভেদে মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার কিছুটা চরিত্রগত ভিন্নতা রয়েছে। এ এলাকায় প্রধানত টাইপ ২ ও অন্যান্য বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায়। গর্ভাবস্থায় প্রথমবার ডায়াবেটিস ধরা পড়ার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে এ এলাকার দেশগুলোয়। উন্নত দেশে মহিলাদের বেশি সংখ্যায় টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ভুগতে দেখা যায়, আর উন্নয়নশীল দেশে পুরুষ টাইপ ২ ডায়াবেটিসে বেশি সংখ্যায় ভোগেন। বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। আগের তথ্যটি কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যেরই প্রকাশ ঘটায়। যেমন- খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম, আনুপাতিক হারে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক অবস্থায় কিছুটা ভিন্নতর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ-অভ্যাস দেখা যায়। আর টাইপ ২ ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় ভোগার হার এবং প্রাবল্যও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। এ বিপুলসংখ্যক ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা ও আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে ডায়াবেটিসের হাত থেকে রক্ষা করতে, এখনই আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি। ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যেটিকে প্রতিরোধ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে, কিন্তু একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে বাকি জীবন ডায়াবেটিস নিয়েই কাটাতে হবে এবং প্রহর গুণতে হবে, কখন ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতাগুলো দেখা দেয়। তাই সব স্তরের মানুষকে জেনে-বুঝে সচেতনভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কর্মযজ্ঞে নিজের সামর্থ্য অনুসারে অংশগ্রহণ করতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে, নতুন নতুন ওষুধ যেমন আবিষ্কৃত হয়েছে, তেমনই প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার কৌশলও পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে আছেন বর্তমানে ডায়াবেটিসের রোগী ও যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস চিকিৎসা যেমন জরুরি, তার চেয়েও বেশি জরুরি ডায়াবেটিস প্রতিরোধের সর্বাত্মক সুগভীর কর্মকাণ্ড। রাষ্ট্রকেই ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে এ কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে, যাতে সব স্তরের মানুষকে যুক্ত করতে হবে। পাঠ্যসূচি থেকে শুরু করে নগর পরিকল্পনা, বিদ্যালয় স্থাপনসহ সব ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রতিরোধসহ মেটাবলিক রোগগুলো নিয়ন্ত্রণের কাঠামোগত উন্নতি করতে হবে। থ্যকণিকা * যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের চিন্তা, স্মরণশক্তি ও স্মৃতিতে সমস্যা হতে পারে। * যাদের অ্যালডোস্টেরন হরমোনের পরিমাণ বেশি তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার দ্বিগুণ আশঙ্কা আছে। * টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেড়ে যায় আর উপকারী কোলেস্টেরল বা এইচডিএল-এর পরিমাণ কমে যায়। ফলে হার্টের রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। * ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতি তিন জনের দু’জন-ই মারা যায় হৃদরোগজনিত কারণে। * ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের আলাদা যত্ন নিতে হবে। * যারা প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হওয়ার কারণে ওষুধ সেবন করে থাকেন, তারা টাইপ-২ ডায়াবেটিস ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। * যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের স্বাভাবিকের চেয়ে সাত গুণ বেশি আশঙ্কা রয়েছে কিডনি রোগ হওয়ার। * ৪০ বছর বয়সের আগে যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে, তাদের দ্বিগুণ আশঙ্কা থাকে মানসিক অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার।
Link copied!