শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১

নাজুক বাঁধই মারণফাঁদ

প্রকাশিত: ০৯:০১ এএম, মে ২৭, ২০২১

নাজুক বাঁধই মারণফাঁদ

প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ আছড়ে পড়েছে ভারতের ওড়িশা রাজ্যের উপকূলে। তবে এর প্রভাব ও পূর্ণিমার প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে ছয় ফুট জোয়ার হওয়ায় প্লাবিত হয়েছে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চল। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। তবে অনেক এলাকায়ই এই জলোচ্ছ্বাসে রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়েছে বাঁধ। আবার অনেক এলাকায় বাঁধ ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে মরণফাঁদ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উপকূলীয় এলাকার বেশির ভাগ জায়গায়ই রয়েছে বাঁধ। খুব অল্প জায়গায়ই বাঁধ নির্মাণ বাকি আছে। আর এই বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাঁধের পেছনে শত শত কোটি টাকা খরচ করার পরও বাঁধ কেন ভাঙে? প্রতিবছর সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কা থাকে। এর আগেই যদি বাঁধগুলো মজবুত করা যায় তাহলে লাখ লাখ মানুষ শঙ্কামুক্ত থাকবে। রক্ষা পাবে তাদের জানমাল। উপকূলীয় এলাকার বেশির ভাগ বাঁধই তৈরি করা হয়েছে সেই ষাটের দশকে। এত দিনে এসব বাঁধ ভেঙে, ফাটল ধরে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। নিচু হওয়ার কারণে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ছে। আর পূর্ণিমার সঙ্গে চন্দ্রগ্রহণ মিলে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলে পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেছে। ফলে বেশির ভাগ বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে নদী আর সাগরতীরের এলাকাগুলোতে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকার মাটির বাঁধগুলো কতটা নাজুক। আম্ফানের এক বছর পরও এ পরিস্থিতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। বহু জায়গায় সেই জোড়াতালি দেওয়া মাটির বাঁধই ভরসা এখনো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরিশাল অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম সরকার বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের বাঁধগুলো সেই ষাটের দশকের। পূর্ণিমার জোয়ারেই বাঁধ ছুঁই ছুঁই উচ্চতায় পানি চলে আসে। এর সঙ্গে যদি ঘূর্ণিঝড় যুক্ত হয় তখন বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢোকে। যেমনটি এবার ইয়াসের প্রভাবে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ মিটার উচ্চতা এবং চওড়াও পাঁচ মিটার বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। আমাদের এখানে এ ধরনের কয়েকটি প্রকল্পের অনুমোদন হলেও বরাদ্দ না আসায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।’ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে গতকাল বুধবার ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার বিষখালী নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার ফুট বেড়ে যাওয়ায় বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ৯টি গ্রাম। খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা ও দাকোপ উপজেলার কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া, পশুর, চুনকুঁড়ি, ঢাকি, শিবসা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বরগুনার বামনা উপজেলার জাফ্রাখালী গ্রামে পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে ছোনবুনিয়া, জাফ্রাখালী, কালাইয়া, তালেশ্বর বুকাবুনিয়া এলাকার নিম্নাঞ্চল। বরগুনা জেলা পাউবো সূত্রে জানা গেছে, বামনা উপজেলায় ৫২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বাঁধ ভেঙে অনেক গ্রাম তলিয়ে গেছে। গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম মাছুদুল আলম কালের কণ্ঠকে জানান, কপোতাক্ষে হঠাৎ জোয়ার বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া, গাঁগড়ামারি এলাকায় বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে ১৫টি গ্রাম তলিয়ে যায়। শ্যামনগরের সোরা গ্রামের বাসিন্দা ফিরোজ, রব্বানীসহ অনেকেই জানান, এ অঞ্চলে টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতিবছরই এই অবস্থা হয়। পাউবো কর্তৃপক্ষকে বারবার বলার পরও কাজের কাজ কিছুই হয় না। যেনতেনভাবে নির্মিত বাঁধ অল্প আঘাতেই নদীতে বিলীন হয়ে যায়। শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের মাদরাসা শিক্ষক আমির হোসেন জানান, এলাকার বেড়িবাঁধগুলো তাঁর জন্মের আগে তৈরি। প্রতিবছর দুর্যোগ আসে। বাঁধ ভাঙার পর সংস্কার করা হয়। তারপর যা হওয়ার তা-ই হয়ে যায়। তাঁরা ত্রাণ চান না। টেকসই বাঁধ চান। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসীম বরণ চক্রবর্তী বলেন, ‘মজবুত বেড়িবাঁধ না থাকায় বছরের পর বছর প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে উপকূলের মানুষের টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে।’ বাঁধই যে রক্ষাকবচ—এর প্রমাণ বাগেরহাটের শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়নের বাঁধ। ইউনিয়নের গাবতলা থেকে বগী পর্যন্ত দুই কিলোমিটারে কোনো বেড়িবাঁধ ছিল না। সেখান দিয়ে আম্ফানের সময় জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢুকে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এবার স্বস্তিতে আছে ওই এলাকার মানুষ। কারণ সেই দুই কিলোমিটারে এখন রিং বেড়িবাঁধ হয়েছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জরুরিভাবে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে এই রিং বাঁধটি। এবারের জলোচ্ছ্বাস তাদের কিছুই করতে পারেনি। পটুয়াখালীর গলাচিপার রতনদী তালতলী ইউনিয়নের সাত গ্রামের মানুষ রাতভর বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। মঙ্গলবার গভীর রাতে জোয়ারের তোড়ে ভেঙে যায় এ বাঁধটি। এর পরই তলিয়ে যায় ওই এলাকার সাতটি গ্রাম। এ ছাড়া উপজেলার চরকাজল এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেছে গলাচিপার তিনটি ইউনিয়নের কমপক্ষে ১৫টি গ্রাম। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু রেজা মো. তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশে আগে ১০ থেকে ১২ বছর পর পর ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হতো। এখন প্রায় প্রতিবছরই জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। জলোচ্ছ্বাস ও উজানের পানি থেকে রক্ষা পেতে ডেল্টা প্ল্যান করতে হবে। করতে হবে নদী খনন। উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধগুলো অনেক আগে নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর উচ্চতা বাড়ানো প্রয়োজন।’
Link copied!