ব্যাংকের কর্ণধারই ঋণ খেলাপি। কিন্তু আইনে আছে একজন ঋণখেলাপি কোনো ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তাকে তার পদ থেকে অপসারণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু, তার ঋণ খেলাপির দায়ে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুত্র জানায়,সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন। জনতা ব্যাংকের কাছে তার খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আমজাদ হোসেন একইসঙ্গে লকপুর গ্রুপেরও চেয়ারম্যান। ঋণ পরিশোধের বদলে বারবার তার কোম্পানির ঋণ পুনঃতফসিলি করায় তাকে 'স্বভাবজাত ঋণ খেলাপি' আখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একজন ঋণখেলাপি কোনো ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তাকে তার পদ থেকে অপসারণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু, তার ঋণ খেলাপির এই ইতিহাস থাকা সত্বেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যখন ঋণ খেলাপ সম্পর্কিত বিদ্যমান আইনই মানা হচ্ছে না, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে নতুন করে কঠোর আইনি বিধান প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। গত বছরের ডিসেম্বরে লকপুর গ্রæপের দুটি কোম্পানি ইস্টার্ন পলিমার ও মুন স্টার পলিমারের ৫৮.৬১ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১০ বছর বাড়ানোর অনুমোদন দেয় জনতা ব্যাংকের বোর্ড। ১০ বছরের মধ্যে ২ বছরের ঋণের কিস্তি না দেওয়ার সুবিধা (মোরেটোরিয়াম) দেওয়া হয়। অর্থাৎ এ সময়কালে ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাধ্যতামূলক নয়। তবে এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। ব্যাংকটির খুলনা কর্পোরেট শাখায় ঋণ গ্রহীতার খেলাপির ইতিহাস গোপন রেখে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ব্যাংকটির দিলকুশা শাখা থেকে লেটার অব ক্রেডিট (এলওসি) হিসেবে এই ঋণ দেওয়া হয়। এছাড়া,খুলনা করপোরেট শাখা চারবার কোম্পানিগুলোর ঋণ পরিশোধের সময় পরিবর্তন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, তৃতীয় বার সময় পরিবর্তনের পরও যদি খেলাপি ঋণ হয়, তবে ঋণ গ্রহীতাকে স্বভাবজাত ঋণ খেলাপি ধরে নেওয়া হবে। তার ঋণ পরিশোধের সময় পরিবর্তন আর বিবেচনা করবে না ব্যাংক এমনটাও উল্লেখ আছে প্রজ্ঞাপনে।প্রজ্ঞাপন নিয়ম অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারিতে জনতা ব্যাংককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই নোটিশে জনতা ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়, কেনো একজন স্বভাবজাত ঋণ খেলাপির ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমোদন দিয়েছে বোর্ড? তবে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতি থাকলেই ঋণ পুনঃতফসিল কার্যকর হয়। এ ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। লকপুর গ্রুপের একাধিক কোম্পানির গুরুতর ঋণ অনিয়মের ঘটনা নজরে আসায় এ সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ‘২০১৯ সাল থেকে অপরিশোধিত আছে ৫৮.৬১ কোটি টাকার ঋণ। দুটি কোম্পানির স্বত্বাধিকারী আমজাদ এসবিএসি ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান। তাই, এক্ষেত্রে ব্যাংকের রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি বিভাগকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।’
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, তাদের কাছে লকপুর গ্রুপের ঋণ অনিয়মের ব্যাপারে তথ্য আছে। এ কারণেই নতুন সময় নির্ধারণের অনুমোদন দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন,আমজাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তার ঋণের ইতিহাস ও ঋণ অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সূত্রগুলো জানায় বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কোভিড-১৯ লকডাউনের কারণে তদন্তের কাজ পিছিয়ে আছে। যোগাযোগ করা হলে জনতা ব্যাংকে তার ঋণ খেলাপির কথা স্বীকার করেন আমজাদ।
তবে তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের বোর্ড ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমোদন দিয়েছে তাকে,এরমধ্যে ২ বছরের মোরেটোরিয়াম সুবিধা আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত না জানানোয় এই প্রস্তাব এখনো কার্যকর হয়নি বলে জানান তিনি। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে আরও জানান,তার ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ৯০ শতাংশই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি তিনি।
তার ঋণ পরিশোধের নতুন সময় নির্ধারণের অনুমোদন কার্যকর হলে কীভাবে তিনি ব্যবসা বন্ধ থাকা অবস্থায় কিস্তি পরিশোধ করবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,তার বর্তমানে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য না থাকায় তিনি ২ বছরের মোরাটোরিয়াম সুবিধা চেয়েছেন। তিনি জানান, এই দুই বছরে তার ব্যবসা ঘুরে দাঁড়ালে তিনি ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। লকপুর গ্রুপের আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে কথা বলতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে একাধিকবার কল করে এবং তার অফিসে গিয়েও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। জনতা ব্যাংক থেকে লকপুর গ্রুপ মোট ৫৭৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এরমধ্যে ঋণের সীমা থেকেও বেশি ২৬.৬৩ কোটি টাকা। ঋণের সীমার মধ্যে ঋণের পরিমাণ নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংকের, কিন্তু তা করেনি জনতা ব্যাংক। তার পরিবর্তে ব্যাংকটি ঋণ গ্রহীতার ঋণের অ্যাকাউন্ট নবায়ন করেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।
ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯৬ কোটি টাকা, অর্থাৎ সঠিক সময়ে এ পরিমাণ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। এছাড়া, ১ কোটি টাকার বিশেষ স্মারকলিপি অ্যাকাউন্ট (এসএমএ) সম্পদের নিম্ন মানের নির্দেশক। ১১ কোটি টাকা হলো সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণ, আর ৫০ কোটি ছিল মন্দ ঋণ। সিআইবি'র ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের ডেটাবেজে তার ৫০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপির কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু জনতা ব্যাংকের স্মারকলিপিতে দেখানো হয়, গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর তার মন্দ ঋণ পরিশোধের নতুন সময় নির্ধারিত হয়েছে। তবে, এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের যাচাই করা তথ্য নয়। ঋণ খেলাপি ছাড়াও কর ফাঁকির ইতিহাসও আছে লকপুর গ্রুপের। সম্প্রতি লকপুর গ্রুপের চারটি কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। বন্ডেড ওয়্যারহাউজের অপব্যবহারের মাধ্যমে কাস্টম শুল্ক ফাঁকি দেওয়া কোম্পনি চারটির লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি তাদের ৩৮ কোটি টাকা জরিমানাও করেছে এনবিআর। কোম্পানি চারটি হলো বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনাল লি., মুন স্টার পলিমার এক্সপোর্ট, ইস্টার্ন পলিমার অ্যান্ড আলফা এক্সেসরিজ এবং এগ্রো এক্সপোর্ট।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত লকপুর গ্রুপের আরেকটি কোম্পানি খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডও অকূল পাথারে পড়েছে। কোম্পানিটি ২০১৪ সালে শেয়ার বাজার থেকে ৪০ কোটি টাকা ওঠায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের হতাশ করে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে 'এ' ক্যাটাগরি থেকে 'জেড' ক্যাটাগরিতে নাম লেখায় কোম্পানিটি। যখন কোনো কোম্পানি ১০ শতাংশের বেশি ডিভিডেন্ড ঘোষণা দেয়, তাদের 'এ' ক্যাটাগরির কোম্পানি ধরা হয়। ডিভিডেন্ড ১০ শতাংশের কম হলে 'বি',আর কোনো ডিভিডেন্ডই না থাকলে সেটি 'জেড' ক্যাটাগরির।
এসবিএসি ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রম-নতুন প্রজন্মের ব্যাংকটি ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে, শুরু থেকেই স্পন্সর পরিচালক হিসেবে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদে ছিলেন আমজাদ। এসবিএসি ব্যাংকেও তার ঋণ আছে। অন্যান্য ব্যাংকের মতো এসবিএসিতেও তার ঋণ পরিশোধে অনিয়ম দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির কোনো খেলাপি ঋণ ছিল না। তবে, ২০১৯ সালে এক লাফে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৬ শতাংশে দাঁড়ায়, যা এর আগের বছরও মাত্র ১ শতাংশ ছিল।মহামারির কারণে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা শিথিল করায় ও ঋণ শ্রেণিকরণ স্থগিত করায় গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে উল্লেখযোগ্যভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসে। কিন্তু, শুধু এসবিএসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হারেই কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখনও ৬ শতাংশের বেশি। গবেষনায় দেখা গেছে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে ঋণ আদায়ে কঠোর হলেও বড়দের ব্যাপারে উৎসাহ অনেকটাই কম। সূত্র-বিএস