রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

ব্যয় মেটাতেই বড় চ্যালেঞ্জে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:০৭ এএম, ডিসেম্বর ২০, ২০২০

ব্যয় মেটাতেই বড় চ্যালেঞ্জে সরকার

চলতি বছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রভাবে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি। রাজস্ব আদায়েও নামে ধস। গত অর্থবছরের শেষ হিসাবে রাজস্ব আয়ে ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘাটতি, ৮৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে করোনার প্রকোপ ধীরে ধীরে কমতে থাকলে স্থবিরতা কাটিয়ে অর্থনীতি গতিশীল হতে শুরু করে। কিন্তু গত নভেম্বর থেকে আবারও করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানিসহ শিল্পের বিভিন্ন খাতে গতিশীলতা কমতে শুরু করেছে। সরকার বাধ্য হয়েই এ মাসে রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ২৯ হাজার কোটি টাকা কমিয়েছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করেছেন, সামাল দেওয়া না গেলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে অর্থনীতিতে। অনেক খাতের খরচে কাটছাঁট করতে হবে। অর্থ সংকটে পড়বে অনেক প্রকল্পের কাজ। খরচের অর্থ জোগাড়ে ঋণে ঝুঁকতে হবে। নষ্ট হবে সমগ্র অর্থনীতির ভারসাম্য। বিগত অর্থবছরগুলোতে জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নের প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থায়নের দায়িত্ব দেওয়া হতো এনবিআরের কাঁধে। করোনার সংকটকালে প্রায় স্থবির অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যেও চলতি অর্থবছরে একই ভার চাপিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে লক্ষ্যমাত্রা কমানোর পরামর্শ দিলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘গত মাস থেকে দ্বিতীয় দফায় করোনার প্রকোপ বেড়েছে। এ ব্যাধির কারণে এরই মধ্যে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি কমেছে। আশঙ্কা করছি, এবারের রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি প্রথম দফার সংক্রমণের সময়ের চেয়ে বেশি হবে।’ একই মত জানিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনার কারণে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতিতে সরকারের অর্থসংকট বাড়বে। অনেক খাতের খরচ কমাতে হবে। খরচের অর্থ জোগাড়ে ঋণ করতে হবে। অর্থসংকটে অনেক খাতের কাজ মাঝপথে থামিয়ে দিতে হবে বা স্থগিত করতে হবে। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর ৮৪.৮৫ শতাংশ পিছিয়ে আছে। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে ৮৩.৩২ শতাংশ, স্থানীয় পর্যায়ে মূসক ৮৫.৯৫ শতাংশ এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর ৮৪.৯১ শতাংশ কম আদায় হয়েছে। মোট রাজস্ব আদায়ে ভ্যাটের অবদান সবচেয়ে বেশি। গত ১০ ডিসেম্বর ভ্যাটবিষয়ক এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাটের অবদান ৩৯ শতাংশে এবং আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের অবদান ৫৭.১৮ শতাংশে উন্নীত হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সার্বিক অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাটের অবদান ৩৯ শতাংশের নিচে এবং আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের অবদান হ্রাস পেয়ে ৫৫.৭৬ শতাংশ হয়েছে।’ চলতি অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ের রাজস্ব ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা, স্থানীয় পর্যায়ে মূসক এক লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা ছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না জেনে তাতে কাটছাঁট করা হয়। গত ১ ডিসেম্বর এনবিআরের গবেষণা ও অনুবিভাগের গবেষণা কর্মকর্তা মো. আল আলীম স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ২৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমিয়ে তিন লাখ ৫০০ কোটি টাকা ধরা হয়। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ের রাজস্ব ৮৫ হাজার ২২১ কোটি টাকা, স্থানীয় পর্যায়ে মূসক এক লাখ আট হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর এক লাখ ছয় হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। কিন্তু করোনার প্রকোপের দ্বিতীয় ধাক্কা এ লক্ষ্য পূরণেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা সংকটে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হিসাবমতো রাজস্ব পরিশোধ সম্ভব নয়—এমন মত জানিয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এতে সরকারের রাজস্ব খাতে আয় কমবে। অর্থনৈতিক সূত্রে বলা যায়, অর্থ সংকটে করোনা আক্রান্ত দেশে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট হবে। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় দফার প্রকোপে এরই মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। করোনা সংক্রমণরোধে অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী আমদানি-রপ্তানি কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। করোনায় শীতের মধ্যে স্থানীয় বাজারেও স্বাভাবিক সময়ের মতো বেচাকেনা নেই। এতে শিল্পের অনেক খাত ক্রমাগত লোকসানে আছে। ব্যবসা-বাণিজ্যেও স্বাভাবিক সময়ের মতো গতি নেই। করোনার প্রথম ধাক্কায় লোকসানে পড়া প্রতিষ্ঠান আবারও কাজে নেবে এমন অঙ্গীকারে বাধ্য হয়ে কর্মী ছাঁটাই করেছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় দফার প্রকোপে ওই সব প্রতিষ্ঠানকে সেই কথা রাখতে দেখা যায়নি। করোনার প্রথম ধাক্কায় বিপর্যস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিপর্যয় দ্বিতীয় ধাক্কায় বাড়ছে। এতে প্রণোদনাসহ আর্থিক নানা সুবিধা দেওয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। কিন্তু এসব দাবি রক্ষায় সরকারের পর্যাপ্ত আয় নেই। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনার প্রথম ধাক্কা মোকাবেলায় সরকার এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। এ প্রণোদনা এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেড়ে গেছে সুদ ব্যয়। চলতিসহ আগামী তিন অর্থবছরে অর্থ মন্ত্রণালয় সুদ খাতে দুই লাখ ২৫ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছিল। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে এ ব্যয়ে আরো অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা যোগ করা হচ্ছে। এ টাকা চলতিসহ আগামী দুই অর্থবছরে সরকারকে পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া করোনার টিকা কেনাসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচও করতে হচ্ছে। সামনে আসছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। ব্যবসায়ীরা নতুন করে আবারও প্রণোদনা দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছেন। একদিকে প্রত্যাশার বিপরীতে রাজস্ব আয় কমে গেছে। অন্যদিকে করোনা মোকাবেলায় বেড়েছে সরকারের খরচ। ফলে ব্যয় নির্বাহের বড় চাপে পড়েছে সরকার। এতে বাধ্য হয়েই সরকার আবারও কৃচ্ছ সাধন নীতির সময় বাড়িয়েছে। আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সব ধরনের ব্যয়ের ক্ষেত্রে এ নীতি অবলম্বন করা হবে। এ নীতিতে প্রকল্পসহ সব ধরনের ব্যয়ের লাগাম টানা হবে। কেনা হবে না নতুন কোনো যানবাহন। বিদেশ ভ্রমণসহ বিলাসী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না সরকারি অফিসগুলো। এতে সরকার ৫০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারবে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, আগামী বছরের শুরুতে অর্থনীতি আগের গতিতে ফিরে না আসলে কৃচ্ছ সাধনেও কাজ হবে না। এতে অর্থবছরের শেষ দিকে এসে সরকারের ব্যাংকঋণ নির্ভরতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
Link copied!