হুইপপুত্রের হুমকি, ‘মুক্তিযোদ্ধা পিটাইয়া হাত পাকাইছি’
প্রকাশিত: ০৮:৪১ এএম, জুন ৯, ২০২১
‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে লেংটা করে ছেড়ে দিবো, রাস্তায় যেদিন কাপড় খুলে রেখে দিবো, সেদিন বুঝবেন। মুক্তিযোদ্ধা পিটাইয়া হাত পাকাইছি, বাড়াবাড়ি করলে থাপড়াইয়া দাঁত ফেলে দিবো।’ এভাবেই হুমকি দিয়েছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর পুত্র নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন। আর যাঁকে হুমকি দেন তিনি চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার বার্তাবাহক মো. দিদারুল আলম, যিনি চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং মহানগর আওয়ামী লীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক।
গত সোমবার কালের কণ্ঠকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দিদারুল আলম বলেন, ‘সেই দিন ছেলের বয়সী শারুনের কথায় বুক ভেঙে যায়। লজ্জায় বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিলাম। পরে পাঁচলাইশ থানায় জিডি করি ও আজম নাছিরকে জানাই। বিষয়টি ভাবলে এখনো ভীষণ খারাপ লাগে।’ শাস্তি না হওয়াতেই শারুন দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, ‘সেই বেয়াদব ছেলেটিই এখন আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য। চট্টগ্রাম তথা সারা দেশের মানুষের কাছে যিনি শ্রদ্ধার পাত্র, সেই প্রধানমন্ত্রীকেও অপমান করতে ছাড়েনি হুইপপুত্র শারুন।’
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এই প্রবীণ নেতা মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসী ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্রটি পাঠ করা হয়েছিল, সেটিরও গর্বিত বাহক ছিলেন দিদারুল। ঘোষণাপত্রটি বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে ওয়্যারলেসে পাঠান, সেখান থেকে চট্টগ্রাম ওয়্যারলেসে পাঠিয়ে অপারেটর তাঁকে ফোন করেন। ভোরে সেটি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের কাছেসহ বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেন। তারপর সেটি পাঠ করেন এম এ হান্নান।
দিদারুল ১ নম্বর সেক্টরে মেজর রফিকুল ইসলামের অধীনে যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে চর হিসেবে কাজ করতে গিয়ে তিনবার ধরা পড়লেও কাকতালীয়ভাবে বেঁচে যান। যুদ্ধের শেষ দিকে ফটিকছড়ি, রাউজানে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। সেই বেঁচে যাওয়াকে দ্বিতীয় জীবন মনে করে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন জীবনে কখনো দুর্নীতির সঙ্গে আপস করবেন না।
দেশের এমন একজন সেনানীকে কোন সাহসে এমন হুমকি? দিদারুল আলম জানান, তিনি যখন চট্টগ্রাম আবাহনীর ফুটবল কমিটির সভাপতি, তখন ক্লাবের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট (প্রিমিয়ার ব্যাংকের জিইসি শাখা) তাঁর, সামশুল হক চৌধুরী ও ম্যানেজারের স্বাক্ষরে পরিচালিত হতো। যেকোনো দুজনের স্বাক্ষরে টাকা তোলা যেত। ওই সময় তিনি জানতে পারেন, কৌশলে ক্লাবের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে পটিয়ায় নির্বাচনে খরচ করছেন সামশুল হক চৌধুরী। দিদারুল বলেন, ‘গোপনে ব্যাংকে একটি চিঠি দিয়ে বলা হয়েছিল, আমি ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারছি না। ঘটনাটি জানার পর ব্যাংকে গিয়ে স্টপ পেমেন্ট করি। এতেই খেপে যায় হুইপপুত্র শারুন। আমাকে বলে, ক্ষমতা দেখাতে চান? পারবেন না। আমি বললাম, কেন পারব না! আমি তো অরিজিনাল, তোমার আব্বা তো বিএনপি, জাতীয় পার্টি হইয়া আওয়ামী লীগে। হঠাৎ বিশ্রী ব্যবহার করল। যা বলেছে, তা কল্পনাতেও ছিল না। সেই দিনই আমাকে থাপড়াইয়া দাঁত ফেলে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল।’
কালের কণ্ঠকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘সামশুল হকের ব্যক্তিজীবনে প্রতারণা ছাড়া ভালো কোনো কাজ একটিও নেই। আমি প্রকাশ্যে বলছি, সাহস থাকলে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুক, প্রমাণ করে দেখাক একটি ভালো কাজ করেছে!’ এক পর্যায়ে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘সামশুল হক হারাম খাইয়া ছেলে জন্ম দিয়েছে, খারাপ না হইয়া ভালো হবে ক্যামনে?’
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সান্নিধ্যের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন দিদারুল। বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর পায়ে সালাম করলে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দিয়েছিলেন।’ তিনি জানান, এ সব স্মৃতিই তাঁকে এখনো আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শে অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে। অনেক আগেই বিএনপি-জাতীয় পার্টি থেকে মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাব পেয়েছিলেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু এবং নীতি-আদর্শের প্রতি থেকেছেন অবিচল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পতাকা উড়িয়ে যেতে চান তিনি।
হুইপ সামশুল হকের অপকর্ম তুলে ধরে মুক্তিযোদ্ধা দিদারুল বলেন, ‘চট্টগ্রাম আবাহনীর উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম। যখন লিমিটেড কম্পানি করা হয়, তখন বের হয়ে আসি, আমাকে অনুরোধ করে ফুটবল কমিটির সভাপতি করেছে। কিন্তু ক্লাবে রাত-দিন ক্যাসিনো জুয়া চলত, সেখানেও আমার দ্বিমত ছিল। প্রতি রাতে ছয় লাখ টাকা আয় করত সামশুল হক ও শারুন। শারুনের সন্ত্রাসীদের দেওয়া হতো এক লাখ টাকা। বাকি পাঁচ লাখ টাকা বাপ-বেটা ভাগ করে নিত। বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেন, ঠিক তখন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও বক্তব্য দিয়েছে ওরা। ওই দিনের পর আমিও বসে থাকতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর কন্যার বিরুদ্ধে যে-ই কথা বলুক, প্রতিবাদ আমি করবই, মুখ বন্ধ থাকবে না।’
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরো বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আজকেও (৬ জুন) ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছি। বার্তায় বলেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই একটি লোক (হুইপ সামশুল হক চৌধুরী) যে কিনা ১৯৭৯ সালে নির্বাচনের আগে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম এলে তাঁর সভা পরিচালনা করেছিল, তখন বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে গালাগাল করছিল। জিয়াউর রহমান ওই সময় তাকে বিচ্ছু সামশু নাম দেন। সেই থেকে সে বিচ্ছু সামশু হিসেবে পরিচিত।’ দিদারুল প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘সামশুল হক চৌধুরীর মতো বিভিন্ন দল থেকে এসে যারা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। যে লোকটা মেশিন চুরি করে জেল খেটেছে, যে লোকটি আওয়ামী লীগের অনেক কর্মীকে নির্যাতন করেছে, জিয়ার বিচ্ছু সামশুর মতো মানুষের গাড়িতে যদি ফ্ল্যাগ থাকে, তাহলে আমাদের আর কিছু বলার থাকে না। সামশুল হকের মতো দুর্নীতিবাজ এবং জামায়াত-হেফাজতের রক্ষক এমন ব্যক্তিকে দ্রুত দল থেকে বিতাড়িত করুন। বঙ্গবন্ধুর আত্মা আমাদের অভিশাপ দিচ্ছে। হুইপ সামশুল হকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই। আমাকে বড় ভাইয়ের মতো জানে। কিন্তু আমি বিবেকের দংশনে ভুগছি, তাই এসব বলছি।’
দিদারুল আরো বলেন, ‘এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর পটিয়া আওয়ামী লীগকে শেষ করে দিয়েছে সামশুল। জামায়াত-হেফাজত ও বিএনপির লোকজনকেও পদ দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কর্মীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। গত পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একজনের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে মনোনয়ন দেয়নি। কিন্তু ৫০ লাখ টাকা নিয়ে বিএনপির একজনকে জিতিয়ে এনেছে। জেলার নেতারা তার পক্ষে নেই।’ দিদারুল আরো বলেন, ‘লোকমুখে শোনা যাচ্ছে কক্সবাজারের ইয়াবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত হুইপপুত্র শারুন। এমনকি হুইপের পিএ এজাজ চৌধুরীর কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার করেছিল প্রশাসন। বিশেষ করে এই ইয়াবার গডফাদার হুইপপুত্র।’ দিদারুল বলেন, ‘সেই দিন ছেলেকে বাঁচাতেই ওই ঘটনায় পিএ এজাজের নাম দেওয়া হয়েছিল। সেই মামলা এখনো তদন্তাধীন, বিষয়টি সবাই জানে।’ প্রবীণ এই মুক্তিযোদ্ধা জানান, শারুন এখন সন্ত্রাসী বাহিনী লালন করেন। কেউ তাঁর অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে এই বাহিনী লেলিয়ে দেন। সূত্র: কালের কণ্ঠ