রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ঘিরে দুর্নীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাকাবের সিরাজগঞ্জের বেলকুচি শাখার পাসওয়ার্ড জালিয়াতি করে মোটা অঙ্কের তহবিল আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ টাকা হাতিয়ে নিতে শাখার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর নানা জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়েছে।
ভুয়া ঋণ সৃষ্টি, ভুয়া ব্যাংক হিসাব খোলা, ভুয়া পে-অর্ডার, জাল স্বাক্ষরে চেক বই ইস্যু ও ভাউচারবিহীন লেনদেন করা হয়েছে। সরকারের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে রাকাবের এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার নামে ৩ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে তা বের করে নেওয়া হয়েছে। অস্তিত্ববিহীন গুদাম ভাড়া করার নামে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। ব্যাংকের অর্গানোগ্রামের বাইরে ভুয়া জনবলের নামে বেতন, বিধানের বাইরে গিয়ে কর্মকর্তাদের লাঞ্চ সাবসিডি (ভর্তুকি), যাতায়াত ভাতা ও গাড়িচালকদের ওভারটাইমের নামে লাখ লাখ টাকা লুটপাট করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, ব্যাংকের পরিবহণের জ্বালানি তেলের ব্যবহার নিয়েও আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক এডভান্স ডিপোজিট রেসিও (এডিআর) অমান্য করে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। যা ব্যাংকটিকে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে।
জানতে চাইলে রাকাবের চেয়ারম্যান রইছ উল আলম মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, নতুন দায়িত্ব নেওয়ার পর শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ঘটনা ঘটার পর নয়, আগেই যেন পদক্ষেপ নেওয়া হয় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, অডিট রিপোর্টের বিষয়ে আমি ব্যাংকের এমডিকে অবহিত করব। বিষয়টি আমি নিজেই ফলোআপ করব। তবে বিষয়টি আমার নজরে নেই।
তিনি আরও বলেন, এক সময় ব্যাংকটির অবস্থা ভালো পর্যায়ে ছিল না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কঠোর পরিপালনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কোনো ধরনের অজুহাত মানা হবে না। সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব (বাণিজ্যি ও বিশেষায়িত অডিট, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃনিরীক্ষা) মৃত্যুঞ্জয় সাহা যুগান্তরকে বলেন, রাকাবের আর্থিক অনিয়মের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এখনো আমার হাতে আসেনি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে গুরুতর অনিয়ম থাকলেও সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি নিরীক্ষা প্রতিবেদন ত্রিপক্ষীয় (মন্ত্রণালয়, অডিট বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক) বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাকাবের প্রতিবেদন দেখে বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, রাকাবের বেলকুচি শাখার কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড জালিয়াতি করে ব্যাংকের তহবিল থেকে ৩৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হাফিজুর রহমান। এ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করেন। এছাড়া ব্যাংক থেকে ওই টাকা বের করার জন্য একজন ভুয়া ব্যক্তির নামে হিসাব খুলে সেখানে টাকা স্থানান্তর করেন। এরপর এ হিসাব থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য শাখা থেকে ভুয়া চেক বই ইস্যু করা হয়।
আরও দেখা গেছে, ডেবিটকৃত চেক ও পে-অর্ডার ছাড়াই অর্থ প্রদান করে টাকা আত্মসাতে সহায়তা করা হয়। পাশাপাশি এ অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে ব্যাংকের শাখায় ভাউচারবিহীন লেনদেন করা হয়। এছাড়া সেখানে স্বাক্ষর ও চেকবই জাল করার মতো ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার নেপথ্যে মূলহোতা ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হাফিজুরসহ ১০ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মামলাও করা হয়েছে।
অর্থ জালিয়াতি প্রসঙ্গে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাকাবের বেলকুচি শাখায় অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও বিভাগীয় নিরীক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হাফিজুর তহবিল তছরুপ করতে পেরেছে। ব্যাংকের নামে ঢাকায় একটি গোডাউন (গুদাম) ভাড়াকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি হয়েছে। ব্যাংক থেকে প্রতি মাসে গুদাম ভাড়া পরিশোধ করা হয়।
এ পর্যন্ত ভাড়া বাবদ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে- ঢাকার যে স্থানে গুদাম ভাড়া নেওয়ার কথা বলে বিল উত্তোলন করা হয়েছে সেখানে গুদামের কোনো অস্তিত্ব নেই। এছাড়া অফিসের গাড়ি ব্যবহার না করে একটি শাখা থেকে আড়াই লাখ টাকার জ্বালানি তেলের দাম হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দুর্র্নীতির ফিরিস্তিতে দেখা গেছে- কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের সঙ্গে যাতায়াত ভাতা, লাঞ্চ সাবসিডি ও চালকদের ওভারটাইমের নামে বিধিবিধানের বাইরে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব খাতে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। এছাড়া ভুয়া জনবল দেখিয়ে প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের অর্গানোগ্রামবহির্ভূত জনবল দেখিয়ে অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, চাতাল মিলের জন্য ব্যবসায়ী শফিকুল আলম ২৫ লাখ টাকা রাকাব থেকে ঋণ নিয়েছেন। এরপর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার দ্বিতীয় ঋণ গ্রহীতা মোসলেম উদ্দিন জীবিত আছেন। এ ঋণের বিপীরতে চাতাল মিল বন্ধ দেখানো হয়। এ ঋণের সুদ প্রায় ১ কোটি টাকা মওকুফ করা হয়। ঋণের টাকাও আদায় করা হয়নি। অডিট বিভাগ বলেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুদ মওকুফ নীতিমালা শর্ত অনুযায়ী বন্ধ প্রকল্পের ক্ষেত্রে জামানত ও সম্পদ বিক্রি করে কস্ট অব ফান্ড পূরণ এবং সব আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরও সব পাওনা আদায় না করা গেলে বা আসল টাকার তিনগুণ আদায় হলে এবং ঋণ গ্রহীতার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়সহ প্রভৃতির জন্য ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ গ্রহীতার ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ করা যাবে।
কিন্তু উল্লিখিত ঘটনায় ঋণ মওকুফ নীতিমালার শর্ত পালন করা হয়নি। এতে ব্যাংকের প্রায় ১ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, সুদ মওকুফ করা চাতালটি বন্ধ থাকার প্রমাণ হিসাবে খাদ্য বিভাগের কোনো প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়নি এবং বিদ্যুৎ বিভাগের কপি গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া এ চাতালের ঋণের বিপরীতে ২৪ কোটি টাকার জামানত সম্পত্তি ছিল। এ জামানত সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পাশাপাশি আইনের আশ্রয়ও গ্রহণ করা হয়নি। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে রাকাব। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকের মোট আমানত হলো ৫ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা এবং মোট ঋণ ৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। এডভান্স ডিপোজিট রেসিও (এডিআর) অনুযায়ী রাকাব উল্লিখিত আমানতের বিপরীতে ঋণ দিতে পারবে ৪ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। সাধারণ অর্থাৎ ১০০ টাকার আমানতের বিপরীতে ৮৫ টাকা ঋণ দেওয়া যাবে। কিন্তু রাকাবে আমানত ও ঋণের অনুপাত হচ্ছে ১০০:৯৫। অর্থাৎ ১০০ টাকার আমানতের বিপরীতে ৯৫ টাকা ঋণ দিয়েছে। ওই হিসাবে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি।