রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের ইসলামী ব্যাংক থেকে বিভিন্ন কায়দায় আকিজ-মিফতা লুট করেছে চার’শ ১২ কোটি টাকা। নগদে এ অর্থ তুলে দেয়া হয় ব্যাংক খেকো এস আলমের এক সময়ের পিএস ও পরে ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিনের হাতে।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ চার বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত যেন অর্থ বের করে নেয়ার অন্যতম খাত হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে লুটেরাদের অর্থ বের করার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয় দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো। গরিব ও অসহায় মানুষের সহায়তার নামে সিএসআর তহবিল থেকে শত শত কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকেই চার বছরে বের করা হয় ৪১২ কোটি টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখা থেকে নগদে এ অর্থ তুলে দেয়া হয় ব্যাংক খেকো এস আলমের এক সময়ের পিএস ও পরে ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিনের হাতে। এস আলমের নির্দেশে অর্থ বের করে দিতে সহায়তা করত ইসলামী ব্যাংকের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা নিজে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তে এমন তথ্য বের হয়ে এসেছে। বিষয়টি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অবহিত করা হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে দুদক এখন অনুসন্ধান শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংক খেকো এস আলমের পক্ষ থেকে বিভিন্œ সময় এমডি মুনিরুল মওলাকে নির্দেশ দেয়া হতো ডিএমডি আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিনকে নগদ অর্থ সরবরাহ করার জন্য। এস আলমের নির্দেশের পর আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিন টাকা বের করে দেয়ার খাতও বলে দিতেন। সে অনুযায়ী অফিস নোট দেয়ার জন্য ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে চাপ প্রয়োগ করা হতো। যারা আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিনের নির্দেশ অমান্য করতেন তাদের ওপর চাকরি চ্যুত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানিসহ নানা দুর্ভোগ নেমে আসত। আর এ কারণেই চাকরি রক্ষার জন্য ও হয়রানীর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অফিস নোটে স্বাক্ষর ও ক্ষেত্রবিশেষে তদারকি করতে বাধ্য হতেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দল ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত চার বছর সিএসআর তহবিল কি খাতে ব্যয় করেছে তার ওপর অনুসন্ধান করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী সিএসআরের বেশির ভাগ অর্থই বের করে নেয়া হয় গরিব ও অসহায় মানুষের সহায়তার নামে। যেমন- ২০২০ সালের ৩০ জুন গরিব ও অসহায় মানুষের সহায়তার নামে বের করে নেয়া হয় ১০ কোটি টাকা। এভাবে বিভিন্ন সময় একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কখনো ১০ কোটি টাকা, কখনো ২০ কোটি টাকা, কখনো ৫০ লাখ টাকা নগদে বের করে নেন আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিন। বেশির ভাগ অর্থই নেয়া হয় নগদে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে।
এভাবে ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি আকিজ উদ্দিন ও ডিএমডি মিফাতা উদ্দিন মাত্র চার বছরে সিএসআর তহবিল থেকে বরে করে নেয় ৪১২ কোটি টাকা। এ দিকে আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিনের বাইরেও সিএসআর তহবিল থেকে শত শত কোটি টাকা বের করে নিয়েছে ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। পতিত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে বিএবি তার নিজের প্যাডে অথবা কখনো মৌখিক নির্দেশে তহবিল ছাড় করার জন্য নির্দেশ দিতো। এ অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংক বিএবির নির্দেশে সিএসআর থেকে অর্থ সরবরাহ করত। যেমন, গত বছরের ১৪ মে শেখ হাসিনা ইন্টার ব্যাংক টুর্নামেন্ট কমিটিকে চাঁদা দেয়া হয় এক কোটি টাকা। কখনো স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মায়ের নামে ফজিলাতুন্নেসা মেডিক্যাল কলেজ,কখনো ভাই শেখ রাসেল টুর্নামেন্টের নামে বিএবির নির্দেশে সিএসআর তহবিল থেকে অবলীলায় অর্থ বের করে দিতো ইসলামী ব্যাংক। সর্বশেষ গত বছরের ২৭ জুন ১০ কোটি টাকা এবং ১০ জুলাই ৯ লাখ টাকা বের করে নেন আকিজ ও মিফতা।
মুনিরুল মওলাকে অপসারণ-দিকে বিভিন্ন জালিয়াতিতে সম্পৃক্ততার দায়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে ২০ মে অপসারণ করা হয়েছে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার ২০ মে এতে অনাপত্তি দিয়েছে। আগামী এক মাস পর তথা ২০ জুন এ অপসারণাদেশ কার্যকর হবে। এর আগে গত ৬ এপ্রিল তাকে বাধ্যতামূলক তিন মাসের ছুটিতে পাঠিয়েছিল ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। জানা গেছে, মুনিরুল মওলাকে অপসারণের পাশাপাশি পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তার অনিয়ম-জালিয়াতির নথি পাঠানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এখন বিধি অনুযায়ী সংস্থাটি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানান, ইসলামী ব্যাংকের সাম্প্রতিক অডিটে বিভিন্ন জালিয়াতির সাথে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সে আলোকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে অনাপত্তি দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের একজন পরিচালক জানান,অপসারণের মানে তিনি দায়মুক্তি পাবেন তেমন না। তার বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে দুদকসহ সরকারের অন্য সংস্থা। এ জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা নিয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংক দখল করে এস আলম গ্রæপ। বিভিন্ন উপায়ে শুধু এই ব্যাংক থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়ার তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ব্যাংকটির পর্ষদের বেশির ভাগ সদস্য ও বেশির ভাগ ডিএমডি আত্মগোপনে চলে যান। অদৃশ্য কারণে মনিরুল মওলা বহাল ছিলেন।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের প্রকৃত খেলাপি ঋণ ঠেকেছে ৬৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ৪২ দশমিক ২২ শতাংশ। এতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। প্রভিশন সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকটি এখন ২০ বছর সময় চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করেছে। অবশ্য ইসলামী ব্যাংক ডিসেম্বর ভিত্তিক যে তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিয়েছিল সেখানে খেলাপি ঋণ দেখানো হয় ৩২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা এক লাখ ৫৫ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা ঋণের, যা ছিল ২১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।সংগৃহীত
আপনার মতামত লিখুন :