শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির অনেক নেতাকর্মী, মন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। দফায় দফায় রিমান্ড শেষে তারা সবাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। টানা ১৫ বছরের সুখে থাকার পর বর্তমানে কারাবন্ধি অবস্থায় তাদের কি অবস্থা তা জানার জনগণের আগ্রহও কম নয়।
বুধবার (২ অক্টোবর) দুপুর পর্যন্ত এ ধরনের বিশেষ বন্দির সংখ্যা ছিল ৬৬ জন। তাদের মধ্যে ডিভিশন পেয়েছেন ৩৭ জন। হাসপাতালে আছেন তিনজন। তাদের কারো সঙ্গেই এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কেউ দেখা করতে আসেননি। এমনকি কোনো নিকটাত্মীয়ও কারাগারে যাননি। এছাড়া ৫ আগস্টের পর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ভিআইপি বন্দিরা কারা অভ্যন্তর থেকে মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ পাননি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কারা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যেসব ডিভিশনপ্রাপ্ত বিশেষ বন্দি আছেন তারা হলেন-দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ-সদস্য সালমান এফ রহমান,সাবেক সংসদ-সদস্য সাদেক খান, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক হুইপ আ স ম ফিরোজ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামছুল হক টুকু, সাবেক উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, সাবেক সংসদ-সদস্য আহম্মেদ হোসাইন, সাবেক রিয়াল অ্যাডমিরাল এম সোহাইল, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক সংসদ-সদস্য আব্দুস সোবহান গোলাপ, হাজী মো. সেলিম, সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান।
এছাড়ও রয়েছেন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদী হাসান চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি আবুল হোসেন মোহাম্মদ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন, সাবেক সংসদ-সদস্য শাহে আলম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, সাবেক সংসদ-সদস্য তানভীর ইমাম, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফি, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, কুষ্টিয়ার সাবেক সংসদ-সদস্য সেলিম আলতাফ জজ, ডিআইজি মিজানুর রহমান, পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এবং যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান।
কারাগারে থাকা বিশেষ বন্দিরা কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন-জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সকালে ঘুম থেকে উঠেই কেউ কেউ নামাজ পড়ছেন। কেউ দেরিতে ঘুম থেকে উঠছেন। কমবেশি সবাই নামাজ পড়ছেন। চা-নাশতা খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন, গল্প-গুজব করেন, পত্রিকা পড়েন। কেউ কেউ কারা লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়েন। দুপুর ১২টার পর গোসলে যান। গোসল শেষে কেউ কুরআন তেলাওয়াত করেন, নামাজ পড়েন। বিকালে নির্ধারিত প্যালেসে হাঁটেন।
সাধারণ বন্দি ও ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের মধ্যে পার্থক্য জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা থাকার জন্য একটি খাট পান। চেয়ার-টেবিল পান। কারা লাইব্রেরিতে সবার জন্য পত্রিকা পড়ার সুবিধা আছে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সাধারণ বন্দিরা নিজ খরচে রুমে নিয়ে পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য কারা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের রুমে পত্রিকা পড়ার সুযোগ করে দেন। তারা টেলিভিশন দেখারও সুযোগ পান। সকালে রুটি-সবজির সঙ্গে জেলি পান। সাধারণ বন্দিদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা না থাকলেও ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের চা দেয়া হয়। সাধারণ বন্দিরা মাছ/ মাংস পান এক বেলা। কিন্তু ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা দুই বেলা মাস/ মাংস পান। কিন্তু পরিমাণ সবার জন্য সমান।
তিনি জানান, ভিআইপি বন্দিরা কারাগারে কাজের লোকও পান। কাজের লোক এক ধরনের সেবক হিসাবে কাজ করেন। ওই সেবক ভিআইপি বন্দির কাপড় ধুয়ে দেন, খাবার সংগ্রহ করে দেন। এছাড়া আনুষঙ্গিক কাজ করে দেন।
কারাসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভিআইপি বন্দিরা কারাগারে বিশেষ সুবিধা দাবি করলেও তাদের তা দেয়া হচ্ছে না। কারাবিধি অনুযায়ী তারা যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা, সেগুলোই তাদের দেয়া হচ্ছে। বিধি অনুযায়ী প্রতি ১৫ দিন পর নিকটাত্মীয়রা বন্দিদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। নিয়ম অনুযায়ী নিকটাত্মীয় ছাড়া বন্দিদের সঙ্গে কারো দেখাসাক্ষাতের সুযোগ নেই। তবে বর্তমানে কারাবন্দি ভিআইপি বন্দিদের সঙ্গে কোনো নিকটাত্মীয়ই দেখা করছেন না। তবে ম্যানেজার টাইপের কেউ একজন এসে দেখা করছেন। তিনিই মামলার খোঁজখবর রাখছেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, একজন বন্দি প্রতি ১০ দিন পর একদিন নির্ধারিত মোবাইল নম্বরে কারাগারের ভেতর থেকে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ বন্দিদের ক্ষেত্রে এ সুযোগ এখনো কেউ পাননি।
এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের এআইজি জান্নাতুল ফরহাদ বলেন, কারাবন্দি বিশেষ বন্দিরা কারাবিধি অনুযায়ী সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। কেউ কেউ বিধিবহির্ভূত সুবিধা দাবি করলেও তাদের সেটা দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, ডিভিশনপ্রাপ্ত ৬৬ বন্দির মধ্যে বেশির ভাগই ৫ আগস্টের পর গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে এর আগেরও দু-একজন আছেন। ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের মধ্যে সাবেক সংসদ-সদস্য শাজাহান খানসহ তিনজন এ মুহূর্তে কারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে তিনি জানান। শেখ হাসিনার ভিআইপি দোসরা কতদিন কারাবন্ধি থাকবেন তার কোনো তথ্য আপাতত মিলছেনা।
আপনার মতামত লিখুন :