শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ফরিদপুরে মন্দিরে আগুন: ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে মারধর করেন মেম্বার ও কয়েক যুবক

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৪, ০৮:৪৭ পিএম

ফরিদপুরে মন্দিরে আগুন: ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে মারধর করেন মেম্বার ও কয়েক যুবক

ফরিদপুরের মধুখালী থানার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামের কালী মন্দিরে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মন্দিরে আগুনের ঘটনায় সন্দেহভাজন নির্মাণশ্রমিকদের মারধরে অংশ নেয় ১০ থেকে ১২ জন। আর এই মারধরের সময় বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত ছিলেন ইউনিয়নটির বর্তমান চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপন। তার উপস্থিতিতেই মারধর শুরু হয়। পরে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠলে তিনি কক্ষ ত্যাগ করেন।

হাতে আসা ওই দিনের ঘটনার দুটি ভিডিওতে এমন চিত্র দেখা গেছে। তবে মন্দিরে আগুনের সূত্রপাত কীভাবে তা এখনো জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে থানায়।

ফরিদপুর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম জানিয়েছেন, এ ঘটনার পরে মধুখালী থানায় মন্দিরে আগুন, দুই নির্মাণশ্রমিককে হত্যা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে।

এসব মামলায় গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুর রহমান বলেন, একটি মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে, তিনি গ্রেপ্তারকৃতদের পরিচয় জানাতে চাননি।

ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে জানা যায়, এলাকাবাসীর গণপিটুনিতে দুই সহোদর নির্মাণশ্রমিকে মারা যান। তবে ঘটনার সময় ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এলাকাবাসীর গণপিটুনিতে নয়, ১০ থেকে ১২ জন লোকের নির্মম নির্যাতনে মৃত্যু হয় দুজন নির্মাণশ্রমিকের।

ওই ভিডিওতে দেখা যায়, পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে নির্মাণশ্রমিকদের পেছন দিকে হাত বেঁধে জেরা করছেন কয়েকজন ব্যক্তি। ওই শ্রেণিকক্ষেই শ্রমিকেরা থাকতেন। এরপর শ্রেণিকক্ষ বন্ধ করে কয়েকজন তরুণ লাঠি ও লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করছে তাঁদের। হলুদ, খয়েরি ও নীল রঙের টি–শার্ট পরা তিন তরুণই বেশি নির্যাতন করেন। এ সময় আর্তচিৎকার করছিলেন শ্রমিকেরা। শ্রেণিকক্ষের বাইরে অবস্থানরত উত্তেজিত জনতা তাতে উৎসাহ দিচ্ছে। উৎসাহ পেয়ে ওই তরুণেরা নির্মাণশ্রমিকদের নির্যাতন চালিয়ে যায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেখানে স্থানীয় প্রভাষ কুমার, উজ্জ্বল, সুফল, সুকুমার, রাজকুমার, সাধন, বিকাশ, সুজিত, মানিকসহ আরও কয়েকজন মারধরে অংশ নিয়েছেন।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সেখানে নির্মাণশ্রমিকদের পিঠমোড়া করে বেঁধে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এই ভিডিওতে সেখানে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য অজিত কুমার সরকারের সঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপনকে দেখা যায়। তপন শ্রমিকদের জেরা করেন। একপর্যায়ে তিনিও শ্রমিকদের মারধর করেন।

জানা গেছে, স্থানীয় প্রভাষ কুমারের ফোনকল পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ইউপি মেম্বার অজিত কুমার সরকার। তিনি শ্রমিকদের শিশু শ্রেণিকক্ষে ঢোকান। পরে দুই নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য লিংকন বিশ্বাস ঘটনাস্থলে আসেন। তখন উত্তেজিত জনতা ‘ধর ধর’ বলে ইটপাটকেল, রড, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে রুমের দরজা জানালা ভাঙতে শুরু করে। পরে উত্তেজনা বাড়তে থাকলে অজিত কুমার সরকার চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপনকে ফোনকল করে ডেকে আনেন।

চেয়ারম্যান কক্ষের ভেতরে যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তিনি বেরিয়ে আসেন এবং থানায় ফোনকল করেন। কিছু সময় পর মধুখালির ইউএনও পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন। এ সময় উত্তেজিত জনতা তাঁদের অবরুদ্ধ করে। পরে ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য শাখার সদস্যরা এসে রাত ১১টার পর রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছুড়ে স্থানীয়দের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ততক্ষণে দুই নির্মাণশ্রমিক মারা গেছেন।

তপন গত শুক্রবার বলেছিলেন, তিনি অল্প কিছু সময় শ্রমিকদের কক্ষে অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তিনি নিজেও শ্রমিকদের কাছে আগুন নিয়ে প্রশ্ন করেন। তবে ভিডিওতে দেখা যায়, তাঁর উপস্থিতিতেই শ্রমিকদের মারধর করা হয়।

এ ভিডিওর ব্যাপারে পুলিশের কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। তাঁরা জানিয়েছেন, ঘটনার তদন্তে ব্যাপক তৎপরতা চলছে।

পুলিশের বিশেষ শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, শুরুতে চেয়ারম্যান ওই কক্ষে যান। তিনি চাইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তবে তিনি ও ইউপি সদস্যরা জেরা করার একপর্যায়ে মারধর শুরু করেন। এটা করা উচিত হয়নি। এতে করে বাইরে থাকা জনতা আরও উত্তেজিত হয়ে ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে চেয়ারম্যান কক্ষ থেকে বের হয়ে যান।

এদিকে আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হলো তা এখনো নিশ্চিত নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে নির্মাণশ্রমিকদের সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় কয়েকজন মুসলিম ছিলেন কেবল ওই নির্মাণশ্রমিকেরাই। সেই কারণে উত্তেজনার মধ্যে নিছক সন্দেহের বশে তাঁদের ওপর হামলা হয়েছে।

পুলিশের সূত্রটি বলছে, আগুন কীভাবে লেগেছে সেটি বের করতে এখন ফরেনসিক টিম কাজ করছে।

উল্লেখ্য, ডুমাইন ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রাম আর পঞ্চপল্লী এলাকা। এই এলাকাটি পাঁচটি গ্রাম নিয়ে। সবগুলো গ্রামই হিন্দু অধ্যুষিত। আশপাশের এলাকাগুলোও হিন্দু অধ্যুষিত। পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শৌচাগার নির্মাণের কাজ করছিলেন কয়েকজন নির্মাণশ্রমিক। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিদ্যালয়টির পাশে অবস্থিত কালী মন্দিরের মূর্তিতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় তাঁদের পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এতে আরশাদুল ও আশরাফুল নামে দুই কিশোরের মৃত্যু হয়। তারা আপন ভাই।

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!