বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১

করোনার পর এবার এইচএমপিভি আতঙ্ক!

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২৫, ১২:০৯ পিএম

করোনার পর এবার এইচএমপিভি আতঙ্ক!

দেশে কোভিডের ধাক্কা শেষ হতে না হতেই, পৃথিবীকে চোখ রাঙাচ্ছে আরও একটি মহামারী এইচএমপিভি ভাইরাস। যে দেশ থেকে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিলো, সেই চীনেই মাথাচাড়া দিয়েছে আরেকটি ভাইরাস। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) নতুন কোনও ভাইরাস না হলেও, চীনে এটির সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই ছড়িয়েছে এশিয়ার কয়েকটি দেশে। 
জাপান,হংকং এবং মালয়েশিয়ার পর,ভারতেও এই ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। বেঙ্গালুরুতে দুই শিশু এবং গুজরাট ও পশ্চিমবঙ্গে একজন করে দুই শিশুর দেহে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এর আগে কর্নাটক, গুজরাট, তামিলনাড়ুতেও ভাইরাসের সংক্রমণ মিলেছে। ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নড্ডা আশ্বস্ত করেছেন, এ ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। পৃথিবীতে বহু বছর ধরেই আছে ভাইরাসটি। 
যে কোনও বয়সের মানুষই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। শীতকালে এবং বসন্তের শুরুর দিকে এই ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। চীনও সেখানে ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণকে একটি শীতকালীন সংক্রমণ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছে। তবে দেশটিতে এইচএমপিভির সংক্রমণ বাড়ছে, বিশেষত ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে। চীনের উত্তরে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় শ্বাসযন্ত্রের রোগের ঘটনা বেড়েছে।
চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে, দেশটির সরকার এই সংক্রমণকে কোভিড-১৯ এর মতো আরেকটি মহামারীর আশঙ্কা করছে না। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন,শীতকালীন ঋতুতে শ্বাসযন্ত্রজনিত সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়। তবে এ বছরের সংক্রমণগুলো তুলনামূলক কম এবং এর বিস্তারও সীমিত।
এালয়েশিয়ায় ২০২৩ সালে ২২৫টি সংক্রমণের তুলনায় ২০২৪ সালে ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩২৭টি সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। হংকং,তাইওয়ান ও কম্বোডিয়াও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কম্বোডিয়ার সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ কোভিড ও ইনফ্লুয়েঞ্জার সঙ্গে এইচএমপিভির সাদৃশ্যের কারণে সতর্কবার্তা জারি করেছে। জাপানও এইচএমপিভি পরিস্থিতি গভীরভাবে নজরদারি করছে।
মহামারীর আশঙ্কা কতটা?বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এটি নতুন ভাইরাস নয়। ২০০১ সালে নেদারল্যান্ডসে প্রথম শিশুদের মধ্যে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। এইচএমপিভি অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রজনিত ভাইরাসের মতো। এটি সাধারণ ঠান্ডা লাগার মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে। বয়স্ক ও শিশুদের জন্য এটি কিছুটা গুরুতর হতে পারে।
চীনের চ্যচিয়াং ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের চিলড্রেনস হাসপাতালের শ্বাসযন্ত্র রোগ বিভাগের প্রধান থাং লানফাং জানিয়েছেন,বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এইচএমপিভি সংক্রমণ মৃদু হয়। তবে কিছু শিশুর সংক্রমণের পর নিউমোনিয়া হতে পারে। শিশু ও বয়স্কদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, দুর্বলতা, কাশি এবং শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রæত চিকিৎসকের শরণাপন্নও হতে হবে।
এই ভাইরাসের জন্য নির্দিষ্ট কোনও অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা বা টিকা নেই বলে উল্লেখ করেছেন চীনের বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রর (সিডিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী চীনের বিশেষজ্ঞরাও যতেœর ওপর জোর দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্রাম, হালকা খাবার এবং উপযুক্ত পোশাক পরা।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়া, পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখা এবং জনাকীর্ণ স্থান এড়ানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস ভাইরাস কি? হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা সংক্ষেপে এইচএমপিভি একটি বায়ুবাহিত ভাইরাস, যা মানুষের শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্থকরে। এটি সর্বপ্রথম শনাক্ত করা হয় ২০০১ সালে নেদারল্যান্ডসে। পরিবেশে থাকা এইচএমপিভি আক্রান্ত যে কোনো জৈব বা এমনকি জড় উপাদানের সংস্পর্শ থেকে ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করে। 
প্রায় ২০০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা এটি আবিষ্কার করে। ২০০১ সালে দ্বিতীয়বার ভাইরাসটিকে দেখা যায়। তখন খুব বেশি গবেষণা হয়নি। বিশেষজ্ঞরাও খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। তৈরি হয়নি ভ্যাকসিনও। প্রায় ২৪ বছর পর আবারও ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। করোনা পরবর্তী সময়ে যা মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
এরপর অন্যান্য ভাইরাসের মতো মুখ নিঃসৃত তরল যেমন হাঁচি-কাশির মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিকভাবে উপসর্গগুলো সাধারণ ঠান্ডা, জ্বর, কাশির মতো হওয়ার কারণে অনেকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপারে উদাসীন থাকেন।
কতটা আতঙ্কের এইচএমপিভি ভাইরাস?বিশিষ্ট চিকিৎসকরা জানিয়েছেন,এইচএমপিভি নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস এবারই প্রথম নয়। আগে ২০০১ সালে চিহ্নিত হয়েছিলো। এর কোনও মিউটেশন হয়েছে কিনা তা এখনও জানা যায়নি। তবে গত ৫০ বছর ধরে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব মানব সভ্যতাতে রয়েছে। 
চীনে যেহেতু কোভিড-১৯ আগে দেখা গিয়েছিলো আর চীনেই এইচএমপিভি ভাইরাসের উপদ্রবও শুরু হয়েছে, তাই খানিকটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। যদিও চীন জানিয়েছে,এটা মৌসুমী প্রকোপ। মহামারী ঘোষণার মতো জায়গায় আসেনি। কোভিড-১৯ একেবারে অন্য ধরনের ভাইরাস ছিলো।
করোনার মতো আরএনএ (রাইবো-নিউক্লিক অ্যাসিড) ভাইরাস হলেও ২০০১ সালে যখন প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়েছিলো,তখনও এইচএমপিভি ততটাও প্রভাব ফেলেনি। সর্দি-কাশি থেকে জ্বর সহ মৃদু থেকে তীব্র উপসর্গ দেখা দিলেও মৃত্যু হয়নি। এবারও তেমন পরিস্থিতিই আশা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। 
তবে কিছু বিশেষজ্ঞের শঙ্কা, ২০২৫ সালে আবার করোনার মতো নতুন কোনো মহামারীর উদ্ভব হতে পারে। যদিও কোন রোগটি মহামারী আকার ধারণ করবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা এখনই তারা দিতে পারেননি। তবে এইচএমভির প্রাদুর্ভাব ভাবাচ্ছে তাঁদের। এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এনিয়ে কোন বার্তা দেয়নি। 
এইচএমপিভি আক্রান্তের উপসর্গগুলো কেমন?মানব শরীরে কম-বেশি সব ভাইরাসের উপস্থিতি একইভাবে প্রকট হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু-এর যে সব উপসর্গ থাকে এইচএমপিভি ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও সেগুলো দেখা যায়। যেমন গলা ব্যথা, সর্দি-কাশি, মাথা ব্যথা, গা-হাত-পা ব্যথা, জ্বর, বুকে সাঁই সাঁই শব্দ, দুর্বলতা হতে পারে।
এই ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণগুলো প্রধানত দুটি পর্যায়ে দেখা যায়। প্রাথমিক বা হালকা লক্ষণের মধ্যে রয়েছে সর্দি বা নাক বন্ধ, কাশি এবং গলা ব্যথা, হালকা জ্বর, প্রচন্ড ক্লান্তি। গুরুতর লক্ষণগুলো হলো-শ্বাসকষ্টের তীব্রতা, বুক ব্যথা এবং অবিরাম কাশি। 
এইচএমপিভি সাধারণত শিশু ও বয়স্কদের আক্রান্ত করে। বেশিরভাগ মানুষ নিজেই সেরে ওঠে। যদি সমস্যা হয়, তবে সাধারণ ওষুধে এটি ভালো হয়ে যায়। বিরল ক্ষেত্রে এটি গুরুতর হতে পারে। যদিও এ ধরনের ভাইরাল রোগের জন্য কোনো বিশেষ ওষুধ নেই। শুধু সোয়াইন ফ্লু’র জন্য একটি ওষুধ তৈরি হয়েছিল।
প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে যাদের ক্যান্সার, হৃদরোগ বা শ্বাসনালি সংক্রান্ত দুরারোগ্য ব্যাধি রয়েছে, তাদের এইচএমপিভিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক অবস্থা দুর্বল থাকায় কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই নবাগত ভাইরাস গোটা শরীরকে গ্রাস করে নিতে পারে।
বেশিরভাগ ভাইরাসই মৌসুম পরিবর্তনের সময়ে বিশেষত শীতকালে মাথাচাড়া দেয়। বায়ুদূষণ বা বাতাসের ধরন পরিবর্তন হওয়ার কারণেই,শীতকালে এদের প্রকোপ বাড়ে।কখনও কখনও শরৎকালেও প্রকট হয়। এইচএমপিভি ভাইরাসের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটিই ঘটেছে। 
ভাইরাসের সংক্রমণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রঙ্কিওলাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। হালকা উপসর্গগুলো সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হয়। তবে কোনোভাবে গুরুতর অবস্থায় উপনীত হলে তা দীর্ঘস্থায়ী জটিলতায় রূপ নেয়। এক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে যেতে হবে। 
স্বাস্থ্য সতর্কতাই সবচেয়ে ভালো টিকা! চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আতঙ্কের বিষয় না হলেও এইচএমপিভি নিয়ে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কোভিড গোটা পৃথিবীকে যে শিক্ষা দিয়েছিলো, সেটি মানুষ ভুলতে বসেছিলো। সেটাই যেন আবারও মনে করিয়ে দেয়ার সময় এসেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে জীবনযাপন করা যাবে, সেটি মনে রাখতে হবে। 
স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। সাধারণত হাঁচি কাশির মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। এছাড়া সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও ছড়াতে পারে। কোথাও হাত দিলে অবশ্যই হাত ধুয়ে মুখে, চোখে হাত দিতে হবে। বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। মোট কথা হাঁচি, কাশির সময় রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকতে হবে। স্বাস্থ্যসচেতনাতার বিকল্প নেই।

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!