দেশের নৌপথগুলোতে নৌযান চলছে চরম ঝুঁকি নিয়ে। জীবনের নিরাপওা নিয়ে চলতে হচ্ছে শ্রমিক-মেহনতি মানুষের। অথৈ সাগর পাড়ি দিলেও কর্মরতদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র মেলে না। পদোন্নতিও হয় না। নেই কোনো সার্ভিস বুক। জানাগেছে আজ মারা গেলে কাল নিঃস্ব হয়ে যায় তাদের পরিবার। কারণ প্রভিডেন্ট ফান্ড, ক্ষতিপূরণ কিছুই দেওয়া হয় না। নেই কল্যাণ তহবিলও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীতে লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য নামাতে নামাতে যখন এসব কথা বলছিলেন মাস্টার খোরশেদ, তখন তাঁর দুই চোখ ছলছল করছিল।
তাঁর কথার রেশ না কাটতেই পাশের লাইটার জাহাজের চালক হুমায়ুন রশিদ বলে ওঠেন, ‘অথচ মালিক, শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে ২০১৯ সালের শেষে একটি ত্রিপক্ষীয় সভায় এসব সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। পাঁচ বছর পার হলেও কোনো দাবিই আলোর মুখ দেখেনি।
শুধু মাস্টার খোরশেদ কিংবা জাহাজচালক হুমায়ুন নন; মনে ক্ষোভ এবং চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে প্রতিদিন সাগর ও নদীপথ পাড়ি দেন দেশের লক্ষাধিক নৌযান শ্রমিক। জীবন ধারণের ন্যূনতম সুবিধা তো মেলেই না, উল্টো ‘পান থেকে চুন খসলেই’ তাদের চাকরি চলে যায়। সামান্য ভুলে যায় প্রাণটাও।
চাঁদপুরের মেঘনা নদীর হাইমচরের ঈশানবালার মাঝেরচর এলাকায় পণ্যবাহী জাহাজে সাতজনকে কুপিয়ে হত্যার পর একে একে স্পষ্ট হচ্ছে নৌপথের হযবরল অবস্থা। বেরিয়ে আসছে শোষণ-বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস। এর মধ্যে মাঝেরচরের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত, বিচারসহ সুযোগ-সুবিধার বিভিন্ন দাবিতে গত২৬ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি শুরু করেছেন পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকরা।
দেওয়া হয় না ন্যূনতম মজুরি-বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, মালিকপক্ষের অতি মুনাফার চেষ্টা এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্লিপ্ততায় বছরের পর বছর ধরে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নৌ শ্রমিকরা। সবশেষ ঘোষণার তিন বছর পার হলেও মজুরি বোর্ড গঠন হয়নি। এমনকি ন্যূনতম মজুরিও বাস্তবায়ন করা যায়নি।
তিনি আরও বলেন, অন্তত পাঁচ বছর আগে থেকে নৌযান শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। সবশেষ বেতন স্কেলে এটি নির্ধারণ করা হয় ৭ হাজার ৮০০ টাকা। সেই বেতনও পান না লস্করসহ নিম্ন পদের ৮০ শতাংশ শ্রমিক। অথচ এসব শ্রমিকের দিনের পর দিন নৌযানে থাকতে হয়। মাসে ৪ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হয় শুধু খাবারেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান,পণ্যবাহী একটি লাইটার জাহাজে মাস্টার, চালকসহ অন্তত ১২ জন কর্মী থাকেন। যাত্রীবাহী জাহাজে এ সংখ্যা ১২ থেকে ১৪ জন। এ ছাড়া পণ্য ওঠানো-নামানোসহ বিভিন্ন শ্রমিক এ সেক্টরে আছেন। সব মিলিয়ে দেশে এমন প্রায় দুই হাজার নৌযানে শ্রমিকের সংখ্যা লক্ষাধিক। অথচ নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্রের মতো চাকরির অনেক মৌলিক শর্তই পূরণ করেন না মালিকরা। এ নিয়ে চলতি বছরই অন্তত সাতবার কর্মবিরতিতে গেছেন নৌযান শ্রমিকরা। প্রতিবারই আশ্বাস পেয়ে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে গেছে তাদের চাওয়াগুলো।
লঙ্ঘিত শ্রম আইন -শ্রম আইন অনুযায়ী, নৌযান শ্রমিকদের জন্য পাঁচ বছর পরপর নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের কথা। সেখানে বলা আছে, দ্রব্যমূল্য ও পরিবারের লোকজন যেন স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়েই বেতন কাঠামো ঠিক করতে হবে। ২০২১ সালের জুনে এই সময়সীমা পার হলেও নতুন মজুরি কাঠামো হয়নি। সবশেষ ২০২২ সালে ১০ দফা দাবিতে নৌযান শ্রিিমকরা সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দিলে সরকার দাবি মানার আশ্বাস দেয়। তবে কোনো প্রাপ্যই নিশ্চিত হয়নি। এ ছাড়া শ্রমিক ও মালিকপক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে দুর্ঘটনা ও কর্মস্থলে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণে ১০ লাখ টাকার যৌক্তিক দাবিও রয়ে গেছে অমীমাংসিত।
এদিকে চলতি বছরের মে মাসে নৌযান শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর সুপারিশ করে তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। দ্রæততম সময়ে মজুরি বাড়ানোর সুপারিশের পাশাপাশি তারা এ নিয়ে নৌযান শ্রমিক ও মালিকদের সঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে বৈঠক করার পরামর্শ দেয়। তবে সেই সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি শেষ পর্যন্ত।
মালিকপক্ষ-শ্রমিক নেতাদের ভিন্ন বক্তব্য-বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম বলেন, নৌপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন লক্ষাধিক শ্রমিক। তাদের জীবনমান উন্নয়নে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। পণ্য পরিবহনে সমতা না থাকায় বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু মালিক শুধু গেজেট অনুযায়ী মজুরি দেন। কিন্তু অধিকাংশ নৌ শ্রমিকই গেজেট অনুযায়ী বেতন পান না। নিম্ন পদের কর্মীদের ৯০ শতাংশ নিয়োগপত্রই পান না। কিছু হলেই চাকরিচ্যুত করা হয়। চাঁদপুরের হাইমচরে একদিনে প্রাণ দিতে হলো সাত নৌ শ্রমিককে। সেই ঘটনা নিয়েও চলছে কানামাছি খেলা।
শ্রমিকদের এমন অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ নৌযান মালিকরা। লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ২০১৭ সালে শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, তারা পরের পাঁচ বছর নতুন কোনো দাবি জানাতে পারবে না। এর পর ২০২২ সালের নভেম্বরে আন্দোলন শুরু করলে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। অথচ পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা থেকে দক্ষিণে যাতায়াতকারী নৌযান কমেছে প্রায় ৫০ ভাগ। সমানতালে কমেছে আয়। ভাড়া কমিয়ে ব্যয় নির্বাহ করাও তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায়ও শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি পূরণ করা হয়েছে। সব ঠিক আছে। তবু কেন আন্দোলন? প্রশ্ন হচ্ছে মালিক বদলায়, জাহাজের ব্যবসায় আয় বাড়লেও শ্রমিকের ভাগ্যের চাকা কেনো ঘুরেনা? দায় কার?সুত্র-সমকাল
আপনার মতামত লিখুন :