সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধরনের বদল আনছে এখন। এ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাতে আসছে ইতিবাচক বদল। তেমনি এক বদলের সূত্রপাত করেছিলেন ব্রাজিলের ২৪ বছরের তরুণী অ্যালিস প্যাটাক্সো। অ্যালিস ব্রাজিলের আমাজন বনে বসবাস করা প্যাটাক্সো গোষ্ঠীর সদস্য। ব্রাজিলের চতুর্থ বৃহত্তর শহর বাহিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে এ গোষ্ঠীর মানুষেরা বসবাস করে। এদের ‘বনরক্ষী’ নামে ডাকা হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের ৮০ শতাংশ রক্ষা করে এরা।
অথচ পুরো বিশ্বের জলবায়ু বদলের ক্ষতির কারণে এই আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষেরা গৃহহীন হয়ে পড়ছে। ২৪ বছর বয়সী অ্যালিস প্যাটাক্সো নিজ গোষ্ঠীর এই কথাগুলোই তুলে ধরেছেন তাঁর ইনস্টাগ্রাম ও এক্স অ্যাকাউন্টে। আর সেগুলো চোখে পড়েছে কপ সম্মেলনের কর্তাব্যক্তিদের। ফলে তিনি কপ ২৬ সম্মেলনে ডাক পেয়েছিলেন। অ্যালিস প্যাটাক্সো নিজ গোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যার কথা বলতে ২০২১ সালে একটি টুইটার (এখন এক্স) অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। সঙ্গে তিনি ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডেলও খোলেন। ইনস্টাগ্রামে তাঁর ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। অ্যালিস পাখির পালকে তৈরি প্যাটাক্সো জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী রঙিন পোশাক ও অলংকার পরে, মুখ ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ট্যাটু এঁকে ভিডিও তৈরি করতেন। সেসব ভিডিওতে থাকত পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা এক আদিবাসী গোষ্ঠীর কষ্টের কথা। থাকত, কীভাবে প্যাটাক্সোরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গৃহহীন হয়ে পড়ছে, সেসব গল্প। শুধু তা–ই নয়, অ্যালিস ব্রাজিলে বসবাসকারী আদিবাসীদের সমস্যা এবং সেখানের নারীদের জন্য জরুরি বিষয়গুলো নিয়েও ভিডিও তৈরি করেছেন। এমনকি তিনি আদিবাসী নারীদের মেকআপ, চুলের যতœ, কৌতুক ও খেলা নিয়েও ভিডিওতে কথা বলেন। নারীদের স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা উল্লেখ করে পেশাদার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান করার বিষয়ে কাজ করেন। তাঁর প্ল্যাটফর্মের সাহায্যে নারীদের ম্যামোগ্রাম ও প্যাপ স্মিয়ারের মতো প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেন। দেশীয় সাহিত্যের মতো অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীদের সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা অ্যালিসের এই বর্ণিল ভিডিওগুলো ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ দেখতে থাকে। এ পর্যায়ে ২০২১ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জাতিসংঘের ২৬তম সম্মেলনে অংশগ্রহণের ডাক পান অ্যালিস। সেই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বনের কোনো মালিক নেই, তবে এর একজন অভিভাবক আছে। তাই আমরা এখানে এসেছি এই অঞ্চলগুলোকে রক্ষা করতে, জীবন রক্ষা করতে।’ মালালা ইউসুফজাই ২০২২ সালে অ্যালিস প্যাটাক্সোকে বিবিসির ১০০ জন খুব প্রভাবশালী এবং অনুপ্রেরণামূলক নারী তালিকার জন্য মনোনীত করেন।
অ্যালিস প্যাটাক্সো যে গ্রামে থাকতেন, সেখানে লেখাপড়া করা ছিল বেশ কঠিন। ব্রাজিলিয়ান মিডিয়া মেঅয়ে অ্যান্ড মেসাজেমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, সে গ্রামে বসবাসের আগে তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে একটি শহরে ছিলেন। উচ্চবিদ্যালয় পর্যায়ে বেশি শিক্ষার্থী না থাকায় গ্রাম থেকে প্রতিদিন তাঁকে অনেক দূরে শহরে যেতে হতো। গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই শহরের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করতেও বেগ পেতে হতো। একসময় আদিবাসীদের স্বাস্থ্য বিষয়ে জানার আগ্রহ জন্মে অ্যালিসার। নিজের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পেতে তিনি ইন্টারনেটের সাহায্য নেন। একপর্যায়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করেন।
বনের অধিবাসী স্বাধীনচেতা প্যাটাক্সোরা বনের যেকোনো জায়গায় বাড়ি তৈরি করত। তাতে কেউ তাদের নিষেধ করত না। কিন্তু শহরে গিয়ে অন্যের জায়গা দখল করলে শুরু হতো থানা-পুলিশ-আইন আদালতের ঝামেলা।অ্যালিস প্যাটাক্সোদের জন্য ভূমি সীমানাসংক্রান্ত আইন নিয়ে ভিডিও তৈরি শুরু করেন। এর ফল হয় দারুণ। প্যাটাক্সোরা ধীরে ধীরে ভূমিসংক্রান্ত আইনগুলো মেনে চলতে শুরু করে। অ্যালিস প্যাটাক্সো কি শুধু ব্রাজিলের মানুষ? সম্ভবত পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের খুব কাছের মানুষ তিনি।
সূত্র: এজেন্সি অ্যাসেনারিয়াম ডট কম ডট বিআর ও মেঅয়ে অ্যান্ড মেসাজেম
আপনার মতামত লিখুন :