দেশের সর্বোচ্চ নিরাপওায় ঘেরা প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। বড়দিনের (বুধবার) ছুটির রাতে আগুনের লেলিহান শিখায় ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় ৭ নম্বর ভবনের ছয়, সাত, আট, নয়-এ মোট চারটি তলা। প্রাথমিক ধারণা, ছয় তলায় আগুনের সূত্রপাত ঘটে। দীর্ঘ প্রায় ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় গভীর রাতে লাগা আগুন নেভে গতকাল সকাল ৮টায়। তবে পুরো আগুন নেভাতে লেগেছে প্রায় ১০ ঘণ্টা।
আগুন নেভাতে এসে মারা গেছেন ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী। নানান মহল থেকে এ অগ্নিকা কে রহস্যময় বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে নানা প্রশ্ন উঠছে। সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এমন বিধ্বংসী আগুন এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে জ্বলা নিয়েই মূলত প্রশ্ন উঠেছে। শুরু হয়েছে একে অন্যের ওপর দোষারোপ। সচিবালয়ে বেশ কিছু ভবন দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎহীন ছিল। এদিকে, গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে অগ্নিকন্ডের প্রকৃত কারণ খুঁজতে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কমিটি তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দেবে। গত রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। সদস্যসচিব করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে। এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন- পুলিশ মহাপরিদর্শক শেখ বাহারুল আলম, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব হামিদুর রহমান খান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর মনজুর, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রাসেল,বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াছির আরাফাত খান এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত। এর আগে দুপুরে আগুনের ঘটনা তদন্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সরকার। সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে তাদের। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ মন্ত্রণালয়গুলো নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আলাদা করে কমিটি গঠন করেছে।
গত বুধবার(২৫ডিসেম্বর) দিবাগত রাত প্রায় ২টার দিকে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগে। আগুন নেভাতে একে একে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট। ২৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টার পর নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন। আগুন নেভার পর সকালেই ক্ষতিগ্রস্থ ভবন পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখশ চৌধুরীসহ কয়েকজন সচিব উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ছয় তলায় আগুন লেগে তা ওপরের দিকে উঠে যায়। নিচে আর আসতে পারেনি। সকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেছেন, সচিবালয়ে আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আট ও নয় তলা। সেখানে থাকা নথিপত্র পুড়ে থাকতে পারে বলে ধারণা হচ্ছে। তবে আগুনের সূত্রপাত নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, ভয়াবহ আগুনে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকে। বিশেষ করে বড় গাড়িগুলো ঢোকানো কঠিন ছিল। সচিবালয়ের গেট ভেঙে দুটি বড় গাড়ি ঢোকানো হয়।
জানা গেছে, আট তলায় পুড়ে মারা যাওয়া একটি কুকুর উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। এত ওপরে কুকুর উঠল কীভাবে তা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। মৃত কুকুরটি পুলিশের ফরেনসিক বিভাগে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ২৬ডিসেম্বর টক অব দ্য কান্ট্রি ছিল সচিবালয়ের অগ্নিকান্ড। আগের দিন বুধবার ২৫ডিসেম্বর ছিল বড়দিনের ছুটি। ছুটির রাতের এ আগুন নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে জনমনে। কয়েক ঘণ্টা ধরে জ্বললেও তা টের পাননি অদূরে থাকা অনেকেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনেছেন আগুনের কথা। কেউ বলছেন ষড়যন্ত্র, কেউ বলছেন পরিকল্পিত অগ্নিকা । বিভিন্ন রাজনৈক দল নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। উৎসুক জনতারও প্রশ্ন- সচিবালয়ের আগুন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেন জ্বলল? এখানে না কোনো কেমিক্যাল আছে, না কোনো তেলের পাম্প; রাস্তাও পুরান ঢাকার মতো সরু নয়। এমন জায়গায় ৬-৭ ঘণ্টা ধরে আগুন জ্বলাটাই তো সম্পূর্ণ রহস্য। গতকাল সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস থাকায় অফিসসূচি অনুযায়ী সকালেই সচিবালয়ে হাজির হন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মী। পাঁচটি গেটের মধ্যে কেবল একটি খোলা থাকায় প্রচন্ড ভিড় লেগে যায়। সে ভিড় পেরিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভেতরে ঢুকলেও দাপ্তরিক কার্যক্রম না হওয়ায় অনেকেই আবার বেরিয়ে যান। আগুন লাগার ঘটনায় সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবন বিদ্যুৎহীন ছিল। বেশির ভাগ লিফট বন্ধ ছিল। কিছু জেনারেটর চললেও অধিকাংশ স্থানে অন্ধকার পরিবেশ ছিল। আগুন নেভাতে গিয়ে মো. সোহানুর জামান নয়ন নামে একজন ফায়ার ফাইটার নিহত হন। তিনি একটি পাইপ নিয়ে সচিবালয় থেকে বেরিয়েছিলেন। এ সময় একটি দ্রæতগামী ট্রাক তাকেসহ তিনজনকে ধাক্কা দেয়। গুরুতর আহত নয়নকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। নয়ন তেজগাঁও ফায়ার টিমের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্য। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমার একজন কর্মী মারা গেল,এর ব্যর্থতা আমার। এ ঘটনার বিচার অবশ্যই হবে। অল্প বয়সে এ ছেলেটা চলে গেল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে তো তার মা-বাবার। অন্য সবাই কিন্তু আস্তে আস্তে ভুলে যাবে কিন্তু মা-বাবা এ মৃত্যু ভুলতে পারবেন না।’ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আসিফ মাহমুদ এ সময় সাখাওয়াত হোসেনকে বলেন, ‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।’ তখন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত আসিফ মাহমুদকে সান্ত¡না দেন। এ সময় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁদের সব নথিপত্র পুড়ে যাওয়ার কথা জানান। ভবনের মাঝখানের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে গিয়ে দেখা গেছে, একেবারে নিচ থেকে পানি এবং ছাইয়ের মিশ্রণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পাঁচ তলা পর্যন্ত আগুনে কোনো ক্ষতি হয়নি। আগুনে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের ছয়, সাত, আট ও নয় তলার ফ্লোর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রতিটি কক্ষের সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়েছে। সিঁড়ি ধসে গেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পোড়া আসবাবপত্রের ধ্বংসস্তুপ। ভিতরের এ অবস্থা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। পুড়ে যাওয়া ভবনটিতে দেখা গেছে, এসব তলায় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এ ভবনের ছয় তলায় শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সাত তলায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। আট তলায় রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের কিছু অংশ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কিছু অংশ। এ ভবনের নয় তলায় রয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
৭ নম্বর ভবনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জানালার ভাঙা কাচের গুঁড়া। ভবনের দক্ষিণ পাশে মরে পড়ে আছে কয়েকটি কবুতর। পুড়ে যাওয়া অংশ থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করছেন বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সচিবালয়ের ভিতরে টহল দিতে দেখা যায় সেনা সদস্যদের। আগুনের ঘটনায় পৃথক দুটি কমিটি করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে একটি এবং ভবিষ্যতে যে কোনো দুর্ঘটনার ফলে উদ্ভূত ক্ষয়ক্ষতি রোধকল্পে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি জানতে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। পল্লী ও সমবায় বিভাগের জন্য আলাদা কমিটি করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ অন্যান্য মন্ত্রণালয় এ ধরনের ক্ষতির হিসাব করতে কমিটি করবে বলেও জানা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের একাধিক সদস্য জানান, আগুন নেভাতে গিয়ে তাঁদের পদে পদে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে।এদিকে নিরাপওার ঘেরাটোপে থাকা সচিবালয়ের ফটক দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভিতরে ঢোকাতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে। সচিবালয়ের সামনে উপস্থিত জনতার কথা হচ্ছে দোষারোপের রাজনীতিনা করে আসল সত্য প্রকাশ করে জাতিকে জানাতে হবে এতো রিাপওায় ঘেরা সচিবালয়ের গুরুত্বর্পূ মন্ত্রনালয়গুলোতে আগুন লাগলো কিভাবে?
আপনার মতামত লিখুন :