সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপসের মতো তার স্ত্রী আফরিন তাপসও রহস্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ শাসনামলের মাত্র কয়েক বছরে শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে দেখা গেছে,অর্জিত কালো টাকা সাদা করতে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেছেন। তারা একই পুকুরকে মৎস্য চাষে পৃথক আয় দেখিয়ে আয়কর নথিতে দুইবার করে উপস্থাপন করেছেন। কাগজে কলমে আলাদা ব্যবসা, আলাদা আয়কর নথি। তবে এক ছাদের নিচে বসবাস। তারা স্বামী-স্ত্রী। শেখ পরিবারের অন্যতম সদস্য শেখ ফজলে নুর তাপস ও তার স্ত্রী আফরিন তাপস। দু’জনের আয়কর নথিতে বিপুল অংকের টাকার আয়। এর মধ্যে শুধু পুকুরে মাছ চাষ থেকেই দু’জনের আয় প্রায় ১০৩ কোটি টাকা!
গোপালগঞ্জের একই পুকুরকে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই আলাদাভাবে আয়কর নথিতে মৎস্য চাষ দেখিয়েছেন একই অর্থবছরে। অবৈধভাবে উপার্জিত কালো টাকাকে সাদা করার শুভংকরের ফাঁকি দেয়ার এমন পুকুর চুরির চেষ্টা করায় শেষ পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে দুদকের জালে আটকা পড়েছেন আফরিন তাপসও।তার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত ও আয়কর হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শেখ ফজলে নুর তাপসের স্ত্রী আফরিন তাপসের ২০১১-২০১২ অর্থ বছরে যেখানে ৫৬ লাখ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল, সেখানে আওয়ামী লীগ শাসনের কয়েক বছরে ১০৫ কোটি টাকারও বেশি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন। স্বামীর সহায়তায় জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদের মালিকানা ও নয়টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা এবং প্রায় ৪ লাখ মার্কিন ডলারের অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন তিনি বলে উল্লেখ করেছে দুদক।
বার্তা সংস্থা বাসস-এ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপসের স্ত্রী আফরিন তাপস গত ২০১২ সালের ১ জুলাই স্বামীর কাছ থেকে তিনটি পুকুর ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সম্পাদিত চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ২ বছরের জন্য লিজ গ্রহণ করেন। তার আয়কর নথিতে এই ২ বছরে মৎস্য চাষে আয় দেখিয়েছেন ৭ কোটি ৫৬ লাখ ১ হাজার ৩০৯ টাকা। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ করবর্ষে ৪ কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার ৫৪৪ টাকা এবং ২০১৪-১৫ করবর্ষে ৩ কোটি ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৭৬৫ টাকা মৎস্যখাতে আয় দেখিয়েছেন।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, শেখ ফজলে নুর তাপস মৎস্য চাষ করার জন্য শেখ ফজলুর রহমান মারুফ’র কাছ থেকে ২০১১ সালের ১ জুলাই গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া মৌজায় ১১টি পুকুরসহ ৪৭ দশমিক ৫৭ একর আয়তনের নাল জমি ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ৩ বছরের জন্য লিজ গ্রহণ করেন। এক বছর পর ওই ১১টি পুকুরের মধ্যে তিনটি পুকুর ২ বছরের জন্য নিজের স্ত্রী আফরিন তাপসকে লিজ প্রদান করেন। অথচ সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, তিনটি পুকুর ব্যতীত বর্ণিত জমিতে আর কোনও পুকুরেরই অস্তিত্ব নেই। অবশিষ্ট জমি ভিটি ও বাগানবাড়ি শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। যেখানে বিভিন্ন গাছপালাসহ বাগান বাড়ি রয়েছে।
দুদকের তদন্ত টিম অনুসন্ধানের সময় তাদেরকে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তাপস ও তার স্ত্রী আফরিন ওই তিনটি পুকুরে কখনও কোনও মাছের চাষ করেননি এবং বাস্তবতার আলোকে সেখানে মাছ চাষ করা সম্ভবও নয়। ফলে মাছ চাষের অযোগ্য তিনটি পুকুরকে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই আয়কর নথিতে মৎস্য চাষের আয় হিসেবে প্রদর্শন করেছেন। আয়কর নথিতে শেখ ফজলে নুর তাপসের মৎস্য খাতে আয় ৯৫ কোটি ২৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩১ টাকা এবং তার স্ত্রী আফরিন তাপসের আয় ৭ কোটি ৫৬ লাখ ১ হাজার ৩০৯ টাকা। অর্থাৎ তিন পুকুরে তিন বছরে স্বামী-স্ত্রীর ভিন্ন ব্যবসা হিসেবে মৎস্য আয় ১০২ কোটি ৮০ লাখ ৪৫ হাজার ৩৪০ টাকা।দুদক বলেছে, এই আয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে শেখ তাপসের অবৈধ আয়কে বৈধতা দিতে ওই তিনটি পুকুরে ২ বছরে মৎস্য চাষ হতে ৭ কোটি ৫৬ লাখ ১ হাজার ৩০৯ টাকা আয় দেখিয়েছেন আফরিন তাপস। আলোচ্য মৎস্য চাষের বাইরে তাপসের স্ত্রীর আয় পাওয়া যায় আরো ২৮ কোটি ৫০ লাখ ৮ হাজার ২৪১ টাকা। দুদকের তদন্তে আফরিন তাপসের নামে নয়টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, তিনি এই নয়টি ব্যাংক একাউন্টে মোট ৭০ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার ৬৬৯ টাকা লেনদেন করেছেন। এর মধ্যে ৩৯ কোটি ৮২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৮২ টাকা জমা এবং ৩১ কোটি ৭ লাখ ২৫ হাজার ৯৮৭ টাকা উত্তোলন করেছেন। বর্তমানে তার ব্যাংক হিসাবে ৮ কোটি ৭৫ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৩ টাকা স্থিতি রয়েছে। এছাড়া মধুমতি ব্যাংক পিএলসি, মতিঝিল শাখার আরএফসিডি হিসাব নং-১১০৩১৫৬০০০০০০০৭-এর মাধ্যমে ২০১৮ সালের ৯ আগস্ট হতে ২০২৪ সালের ১১ মার্চ পর্যন্ত ২ লাখ ২ হাজার ২৫৯ মার্কিন ডলার জমা এবং ১ লাখ ৯৩ হাজার ৭০৪ মার্কিন ডলার উত্তোলন করেছেন আফরিন তাপস। বর্তমানে ওই হিসাবে ৮ হাজার ৫৫৫ মার্কিন ডলার স্থিতি রয়েছে। উল্লেখিত লেনদেন তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে জানায় দুদক তদন্ত টিম। এভাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ জ্ঞাতসারে হস্তান্তর ও স্থানান্তর করে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন,২০১২ এর ৪(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন আফরিন তাপস। নিজেকে ব্যবসায়ী উল্লেখ করলেও ব্যবসার ধরণ বলেননি। অথচ ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ দেখিয়েছেন ৩ কোটি ১৫ লাখ ২১ হাজার ৫৪ টাকা। উপহার হিসেবে পেয়েছেন ৫০০ ভরি স্বর্ণ। ১ কোটি ৬২ লাখ ৮৫ হাজার ৫১৩ টাকা মূল্যের একটি গাড়ি রয়েছে ( ঢাকা মেট্রো-১৩-৭৪৭৪) তার নামে।দুদক কর্মকর্তা জানান, দুই বছর মৎস্য চাষ করলেও আফরিন তাপস ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে রীতিমতো কৃষিজীবী। চলতি অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবছর ২২ হাজার টাকা করে কৃষিখাত থেকে আয় দেখিয়েছেন। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে স্বামী শেখ ফজলে নুর তাপসের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছেন ৫ কোটি ৮৪ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭৭ টাকা। আফরিনের মায়ের মৃত্যুর পর ব্যাংকে মায়ের জমাকৃত টাকার অংশীদারিত্ব বণ্টনে তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৬৭ টাকা।অনুসন্ধান তথ্যে দেখা যায়, আফরিন তাপসের নামে ধানমন্ডির ৭ নং রোড়ের প্লট নং-৫০০/ই (পুরাতন), ০২ (নতুন)-এর রূপায়ন প্রাইম আবাসিক এলাকায় ৫,৩১৯ বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট দু’টি ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নং-এ/৮ ও বি/৮) রয়েছে। ২০১৩ সালের ১৬ জুন রেজিস্ট্রিকৃত (দলিল নং-২৪৫৩) এ দু’টি ফ্ল্যাটের মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৬৬ লাখ ১১ হাজার ৪৩১ টাকা। যা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ দু’টি ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক ৬ কোটি টাকা।
এছাড়া গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানার চান্দনা মৌজায় ৮২ শতাংশ চালা জমি রয়েছে আফরিনের নামে। ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর রেজিস্ট্রি করা এসব জমির ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ৬ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার ১০৮ টাকা (দলিল নং-৯৪৮৮)। দুদক মনে করছে, এসব জমির প্রকৃত মূল্য ১৫ কোটি টাকার বেশি হতে পারে।নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ইউসুফগঞ্জ মৌজায় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০২ নং সড়কের ২ নং প্লটটিও আফরিন তাপসের। জমির পরিমাণ ৯ কাঠা ১৫ ছটাক ৩৭ বর্গফুট (জমি দলিল নং-১৪৩১৭)। ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর রেজিস্ট্র্রি করা জমির দলিল মূল্য ৫ কোটি ৪০ লাখ ৪০ হাজার ২৪০ টাকা। ফলে দেখা যাচ্ছে, ব্যবসার আয়, মৎস্য চাষ, ব্যাংক সুদ, ব্যাংকে নগদ টাকার বাইরেও আয়কর নথিতে আফরিনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এসব সম্পদের মূল্য প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা।দুদক সূত্র জানান, আফরিন তাপসের মোট ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩৯ টাকা আয়ের মধ্যে ১৩ কোটি ২৬ লাখ ৬৭ হাজার ৭৭৯ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ। ১৪ কোটি ১২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৩৫ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। পারিবারিক ব্যয় রয়েছে ৭ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ৯২৫ টাকা।দুদক তথ্য যাছাই-বাছাই করে দেখতে পায়, আফরিন তাপস ৬ কোটি ৪০ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮ টাকা মূল্যের সম্পদ অবৈধভাবে অর্জনপূর্বক ভোগদখলে রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। অপরদিকে তার স্বামী শেখ ফজলে নুর তাপস প্রকৃত আয়ের বাইরে ৭৩ কোটি ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭ টাকা মূল্যের সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন ও ভোগদখলে রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন,২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।শেখ ফজলে নুর তাপসের বাবা শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন শেখ মুজিবর রহমানের ভাগ্নে এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে। বর্তমানে স্বামী তাপসের সঙ্গে আফরিনও পলাতক রয়েছেন। মেয়রের আসনে আসার আগে ঢাকা-১০এর এমপি ছিলেন ১০বছর। দুহাত ভরে কামিযেছেন, বাদ যায়নি ময়লার টাকাও।
আপনার মতামত লিখুন :