ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয়ে থেকে গত ছয় মাসে বেশ কয়েকবার বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন নানা মাধ্যমে। এসব বক্তব্যে তাঁর অতীত কর্মকান্ডের জন্য বিন্দুমাত্র অনুতাপ-অনুশোচনা প্রকাশ পায়নি বরং নিজের সব কর্মকান্ডের পক্ষে সাফাই গাওয়ার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপানো ও বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা স্পষ্ট। বিষয়টি নিয়ে তাঁর প্রতি একদা সহানুভূতিশীল অনেককেই বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখেছি সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘরোয়া আলাপচারিতায়। কাজেই তাঁর কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে জীবন বাজি রেখে যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এমন পরিস্থিতিতে ‘ছাত্রসমাজের উদ্দেশে’শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের ঘোষণা আন্দোলনকারীদের বিক্ষুব্ধ করবে, এটাই স্বাভাবিক। তা-ও আবার শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের ছয় মাস পূর্তির দিনে বক্তব্যটি প্রচারের ঘোষণা দেওয়া হয় নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রসংগঠনের পেজে এবং যথারীতি প্রচারও করা হয়। ভাষণটি প্রচারিত হওয়ার আগেই কেবল তা ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ৫ ফেব্রæয়ারি বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর (নতুন নম্বর ১১) সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবন ধ্বংস করার কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। দেশে ও প্রবাসে থাকা বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির পক্ষ থেকেও অনুরূপ ঘোষণা দেওয়া হয়। সেদিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় ভবনটি ভাঙার কাজ। রাতে ব্যবহার করা হয় ক্রেন ও এক্সকাভেটর। পরদিনও চলে ভবনটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার কার্যক্রম। শুধু তা-ই নয়, ৫ ফেব্রæয়ারি রাতে ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার বাড়ি সুধা সদনেও আগুন দেওয়া হয়। পরদিন বাড়িটিতে চলে লুটতরাজ। বুধবার রাতেই ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটে খুলনায় এবং পরদিন তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। সেসব স্থানে ভাঙচুর করা এবং আগুন দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িসহ শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার নামযুক্ত বিভিন্ন স্থাপনায়।
দেশে দুই দিন ধরে চলা এ ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য কেউ কেউ ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকেই দায়ী করছেন। এমনকি ৬ ফেব্রæয়ারি অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতেও ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনা প্রসঙ্গে বলা হয়, পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধ সৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এ ঘটনা ঘটেছে।’ সংগত কারণেই সরকারের ভূমিকার সমালোচনা হচ্ছে। দেশব্যাপী সংঘটিত অস্বাভাবিক ভাঙচুর ও সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। শুক্রবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক উত্তরণ, সুশাসন ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে শুধু বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করা নয়, সরকারের কার্যকর ভূমিকাও অপরিহার্য। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,‘আগে থেকে সহিংস কর্মসূচির ঘোষণা থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা ও তার সঙ্গে সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনরত সেনাবাহিনী,তথা সরকার কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আশঙ্কাজনকভাবে নির্লিপ্ততার পরিচয় দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে ঘটনাটি“অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত” এমন বিবৃতি দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টাও লক্ষণীয়।’
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেক বিশিষ্টজনও। বিশেষ করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার নিন্দা জানিয়ে দেশের বিশিষ্ট ২৬ নাগরিকের দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে নির্মমতার সঙ্গে বাড়িটি ধ্বংস করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনা-পরবর্তী একটি বিবৃতি দিয়ে এ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। বিবৃতিদাতারা বলেন, ৫ ও ৬ ফেব্রæয়ারির ঘটনার দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টাসহ অন্তর্র্বতী সরকারের ওপরেই অনেকাংশে বর্তায়। বিবৃতিতে বলা হয়, যেভাবে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়িটি ক্রেন, বুলডোজার ব্যবহার করে নির্মমভাবে ধূলিসাৎ করা হয়েছে এবং তার সঙ্গে অন্য যেসব স্থাপনা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে নির্মমতার সঙ্গে ধ্বংস করা হয়েছে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা দেখে একটি সভ্য দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত,স্তম্ভিত ও লজ্জিত। এ ঘটনার আমরা বিচার চাই।’
যেকোনো দেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থান কিংবা স্থাপনা সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সেই দেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের। ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, বাড়ি বা অন্য কোনো স্থাপনা তাতে কারা কোন সময় বসবাস করেছেন বা কাদের নাম জড়িত, সেই নিরিখে বিচার্য নয়। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের যে মূল্যায়নই থাকুক না কেন, তার ওপরে তার সুরক্ষার বিষয়টি নির্ভর করে না। এই সুরক্ষা দেওয়াটা সভ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে বলা দরকার, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কোনো সম্পত্তি নয়। এটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, যেটি কিনা এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রস্তুতিকালের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ স্মারক। এই ইতিহাস কেবল একটি দল বা একটি পরিবারের নয়, সমগ্র দেশ ও জাতির ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বাড়িতেই সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে। পরবর্তী সময়ে একটি ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। অথচ বাড়িটি যারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তাদের দাবি, এটি নাকি ফ্যাসিবাদের প্রতীক। গত বছরের ৫ আগস্টও বাড়িটিতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছিল, তবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়নি। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্মারক তখনো আক্রান্ত হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট দেশে যা ঘটেছে, সেটিকে কেউ কেউ বিপ্লব বলে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেও আদতে তা একটি গণ-অভ্যুত্থান। বিশ্ব ইতিহাসে বিপ্লবের নজির হিসেবে ধরা হয় ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ও ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ায় পর পর দুই দফা বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। প্রথম দফায় ফেব্রæয়ারি (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে মার্চ) মাসে সংঘটিত বিপ্লবকে বলা হয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। ওই বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে অপসারিত করে সপরিবারে কারাবন্দী করা হয়েছিল। আত্মগোপনে থাকা বলশেভিক বা কমিউনিস্টরা পেত্রোগ্রাদে ফিরে প্রথমে কেরেনেস্কি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করেই এগোচ্ছিলেন। কারণ,পার্লামেন্টে তখন বলশেভিকরা ছিলেন সংখ্যালঘু। তবে এপ্রিলের শুরুতে লেনিন পেত্রোগ্রাদে ফেরার পরপরই পরিস্থিতির মোড় ঘুরতে শুরু করল। দেশে ফিরেই লেনিন ঘোষণা করলেন, রাশিয়ায় বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কোনো প্রয়োজন নেই, রাশিয়ার সরকার পরিচালিত হবে শ্রমিক ও কৃষকের দ্বারা। তিনি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে এগোতে থাকলেন। অবশেষে ২৫ অক্টোবর (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে ৭ নভেম্বর) জনগণের সমর্থন নিয়ে বলশেভিকরা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলোতে হানা দিয়ে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৮ সালের ১৬ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টি জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে সপরিবারে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই রাতে জারের পরিবারের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হলেও জারের বাসভবন ধ্বংস করা হয়নি। বাড়িটিকে জাদুঘর বানানো হয়েছে, যা এখনো সুরক্ষিত।
দেশে গণ-অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর যা ভাঙার দরকার ছিল, গত ছয় মাসে আমরা তার কিছু কি ভেঙেছি? ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান হলো একটি বৈষম্যমুক্ত ও সমতার দেশ গড়ার লক্ষ্যে। অথচ ছয় মাসে আমরা বাজার সিন্ডিকেটের টিকিটিও ছুঁতে পারিনি। গণমুখী বাজারব্যবস্থা গড়ার কোনো পদক্ষেপই নেই। আমলাতন্ত্রচালিত ও ধনিকশ্রেণির নেতৃত্বাধীন যে শোষণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি করে, সেটি ভাঙার কোনো উদ্যোগ কি আমাদের আছে? সেদিকে নজর না দিয়ে আমরা ভবন ভাঙা আর ইতিহাস মোছার চেষ্টায় মত্ত। অথচ ইতিহাস যে মোছা বা বদলানো যায় না, তার প্রমাণের তো অভাব নেই। কেউ কেউ ৩২ নম্বর বদলানোর পরামর্শও দিচ্ছেন। তারা কি জানেন না, বহু বছর আগেই সরকার সেটি বদল করে ১১ করেছে! কিন্তু এত বছরেও কেউ কি ১১ উচ্চারণ করেছে? এসব মোছামুছি আর ভাঙাভাঙি করে সামনে এগোনো যাবে না। এগোতে হলে ইতিহাস নয়,ব্যবস্থা বদলাতে হবে।সুত্র-আজকের পত্রিকা:লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :