বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ৬ ফাল্গুন ১৪৩১

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক সৌদি আরবে হওয়ার কথা কেন উঠল?

বিশ্ব ডেস্ক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৫, ১২:০০ এএম

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক সৌদি আরবে হওয়ার কথা কেন উঠল?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের পথ খোঁজার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সৌদি আরবে বৈঠক করতে পারেন তিনি। এরপর অনেকের মনেই প্রশ্ন এসেছে,তিনি কেন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ সম্মেলনের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে উপসাগরীয় দেশটিকে বেছে নিলেন। তিনি বৈঠকের নির্দিষ্ট তারিখ জানাননি,তবে এটি শিগগিরই হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমনকি সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানও এতে অংশ নিতে পারেন বলে উল্লেখ করেন ট্রাম্প।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পর ট্রাম্প এমন মন্তব্য করেছেন। সৌদি আরব এক বিবৃতিতে ট্রাম্প ও পুতিনের ফোনালাপ ও দেশটিতে সম্ভাব্য শীর্ষ সম্মেলনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সৌদি আরব তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।’
নিরপেক্ষ স্থান-আসন্ন ট্রাম্প-পুতিন সম্মেলনের জন্য চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশ আয়োজক হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।তবে মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট পল সেলেম মনে করেন, ‘ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের জন্য সৌদি আরব একটি যৌক্তিক পছন্দ, কারণ এটি নিরপেক্ষ ভেন্যু।’তিনি ব্যাখ্যা করেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপের কঠোর অবস্থানের কারণে কোনো ইউরোপীয় দেশে এই বৈঠক আয়োজন সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক খাত্তার আবু দিয়াব বলেন, ‘ঐতিহ্যগতভাবে নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে জেনেভার মতো স্থান বেছে নেওয়া হতো। তবে রাশিয়ার সঙ্গে সুইজারল্যান্ড ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটায় এবার বিকল্প হিসেবে সৌদি আরবকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো জানান, সৌদি আরব পুতিনের সঙ্গে সফলভাবে পারস্পরিক স্বার্থ ও আস্থার ভিত গড়ে তুলেছে এবং দেশটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সদস্য নয়, যা পুতিনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে পুতিনের সেখানে গেলে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নেই। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরবে গেলে পুতিনের গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নেই।
সম্প্রতি রিয়াদের মধ্যস্থতায় এক বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে রাশিয়া তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে আটক থাকা মার্কিন শিক্ষক মার্ক ফোগেলকে মুক্তি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফের মতে,মার্ক ফোগেলের মুক্তিতে সৌদি যুবরাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
সৌদি আরব আগে থেকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে একাধিকবার স্বাগত জানিয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এ উদ্দেশ্যে দেশটি জেদ্দায় একটি আন্তর্জাতিক বৈঠকের আয়োজন করেছিল, যেখানে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বন্দি বিনিময়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সৌদি আরব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং উভয় দেশের আস্থা অর্জন করেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পুতিনের রিয়াদ সফরের সময় সৌদি যুবরাজ তাকে ‘সরকারিভাবে ও জনগণের কাছে সৌদি আরবের বিশেষ ও সম্মানিত অতিথি’ বলে অভিহিত করেন। উপসাগরীয় দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক আবদুল্লাহ বাবুদ মনে করেন, ওমান, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো সৌদি আরবও বিভিন্ন ইস্যুতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে চায় এবং নিজেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।বাবুদ মনে করেন, ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক আয়োজন করে সৌদি আরব কূটনৈতিক সুবিধা পেতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থে রিয়াদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিনিময়ে আসতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হতে পারে আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর, যে চুক্তি চারটি আরবদেশ ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে।অন্যদিকে পল সেলেমের মতে,ট্রাম্প অর্থনৈতিক, আর্থিক, বিনিয়োগ ও কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্ক আরো মজবুত করতে চান। তিনি ভবিষ্যতে সম্ভাব্য যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি-ইসরায়েল চুক্তির জন্য কাজ করতে আগ্রহী।
এ ছাড়া স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনের অধ্যাপক ড. নিদাল চৌকের মনে করেন, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যনীতি, বিশেষ করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে সৌদি আরব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সৌদি আরবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক চাপের কথাও তুলে ধরেন, বিশেষ করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার বাসিন্দাদের উপসাগরীয় দেশে স্থানান্তরের যে মন্তব্য করেছেন, তা সৌদি আরব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ কারণে সৌদি আরবের ওপর চাপ আরো বাড়িয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদক দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, এর পরই সৌদি আরব ও রাশিয়ার অবস্থান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরব তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ২২টি তেল রপ্তানিকারক দেশের জোট ওপেক প্লাসের আট সদস্য দেশ তেলের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা স্থগিত করে। কারণ তারা প্রত্যাশার চেয়ে কম চাহিদা ও অনুমোদিত নয় এমন দেশের তেল উৎপাদনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছিল। বিশ্লেষক আবদুল্লাহ বাবুদের মতে, বড় তেল উৎপাদক দেশ হিসেবে সৌদি আরব ও রাশিয়ার স্বার্থ অভিন্ন। তিনি আশা করেন, ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পাশাপাশি বৈশ্বিক তেলের দাম ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
বাবুদ বলেন, ‘ট্রাম্প সম্ভবত মার্কিন জ্বালানি কম্পানিগুলোর জন্য অপরিশোধিত তেলের ভালো দাম নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন। বিশেষ করে অতীতে তিনি কম দামের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, যা তার জীবাশ্ম জ্বালানি নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’তিনি উল্লেখ করেন, ট্রাম্প পরিশোধিত জ্বালানির তুলনায় জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেন, যা সৌদি আরবের মতো বড় তেল রপ্তানিকারক দেশের ভূমিকার সঙ্গে মিলে যায়। কেননা সৌদি আরবও জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে,তাই তাদের স্বার্থও মিলছে।
কৌশলগত স্বার্থ-ট্রাম্পের কৌশলগত স্বার্থেও সৌদি আরব গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৭ সালে তার প্রথম বিদেশ সফর ছিল সৌদি আরবে, যা দেশটির কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করেছিল। ট্রাম্প ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হলে আবার সৌদি আরবে প্রথম সফর করতে পারেন। তবে এর পেছনে তিনি একটি শর্তও জুড়ে দিয়েছেন।
ট্রাম্প গত মাসে ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের বলেন,‘যদি সৌদি আরব আমাদের থেকে ৪৫০-৫০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কিনতে চায়...তাহলে আমি সম্ভবত সেখানে যাব।’
কয়েক দিন পর, সৌদি আরবের যুবরাজ বলেছেন, তারা পরবর্তী চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে।পরে ট্রাম্প দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে বলেন, ‘কিন্তু আমি যুবরাজের কাছে বলব, যিনি একজন দুর্দান্ত ব্যক্তি, তিনি যেন এই বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় এক ট্রিলিয়ন করে দেন। আমি মনে করি তারা এটি করবে। কারণ আমরা তাদের জন্য খুব ভালো কাজ করেছি।’
ড. নিদাল চৌকেরের মতে, ট্রাম্প সৌদি আরবকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে দেখেন। ট্রাম্প উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এশিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়ার পর থেকে তিনি এই প্রচেষ্টা শুরু করেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. খাত্তার আবু দিয়াব বলেন, চীনের সঙ্গে ওয়াশিংটনের কৌশলগত প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে ট্রাম্প সৌদি আরব ও আশেপাশের অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রেও প্রভাব আরো বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। সহজ করে বললে,ট্রাম্প চীনকে প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলতে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব আরো শক্তিশালী করতে চান।
যদিও সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে, আবু দিয়াব ও চৌকেরের মতে, সাম্প্রতিক কিছু পরিবর্তন, যেমন ধর্মীয় পুলিশ বাতিল করা বা নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া সৌদি আরবের ভাবমূর্তি বিশ্বব্যাপী উন্নত করেছে। এটা ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে তাদের রাজনৈতিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতাও বাড়িয়েছে।সুত্র-বিবিসি

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!