সাধারণের সঞ্চয়, গ্রাহকের আমানত কিংবা ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের বড় অংশ এখন নানাভাবে বাজারে হাতবদল হচ্ছে। অর্থাৎ মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে টাকা। এভাবে টাকার সরবরাহ অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে দেশে এখন ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে। মুদ্রাস্ফীতি মানে অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি বোঝায়। তাতে সীমিত পণ্য ও সেবার পেছনে বিস্তর টাকা ব্যয় হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছর মার্চ, ২০২২-এ দেশে ব্রড মানির (এম-২) পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ২৯ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা, যা চলতি বছর একই সময় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকায়। এর মানে হলো ব্যাংকের বিভিন্ন মেয়াদি আমানতের বড় অংশ মেয়াদোত্তীর্ণের পর উত্তোলনের মাধ্যমে বাজারে চলে এসেছে। এ কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির অসহনীয় উত্তাপ সত্ত্বেও মানুষের ভোগ-চাহিদা কমছে না। মূল্যস্ফীতি বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের দ্রব্য বা সেবার মূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে বোঝায়। চাহিদা ও জোগানের অসমতার কারণে সাধারণত মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান বাদে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাস, সার, খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেলের যে দাম, সে তুলনায় দেশের বাজারমূল্য অনেক বেশি।
মূলত সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, অনুৎপাদনশীল খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, ঘাটতি বাজেট পূরণে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণ গ্রহণের বিপরীতে মোটা অঙ্কের সুদ পরিশোধ এবং অভ্যন্তরীণ চোরাচালান ও মজুতদারি কারণে ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়। বর্তমানে দেশে গত (নভেম্বর ২০২২-এপ্রিল ২০২৩) এ ৬ মাসের সাধারণ মূল্যস্ফীতির গড় হার ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। এটা আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার।
বাজেট প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এ লক্ষ্যে আসন্ন বাজেটে এ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম কৌশল হিসেবে বাজারে টাকার সরবরাহ কমিয়ে আনতে চায় বা সৃষ্ট ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দমন করতে চায় সরকার। এজন্য মুদ্রানীতির মাধ্যমে বেসরকারি খাতে ঋণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। একই উদ্দেশ্যে বিদ্যমান সুদের হার ও বিনিময় হারকে বাজারের চাহিদার ওপর ছেড়ে দিতে যাচ্ছে সরকার। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুনে যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে, তার বহুমুখী নির্দেশনার আলোকেই এ কৌশল বাস্তবায়ন করবে। তবে শুধু মুদ্রাস্ফীতি কমানোর পদক্ষেপেই বসে থাকবে না সরকার। এর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য কৌশলের অংশ হিসেবে পণ্যের আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি রুখবে সরকার। এটাও করা হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সক্রিয় করার মাধ্যমে। অর্থাৎ ব্যাংক কর্মকর্তা ও আমদানিকারকদের অশুভ আঁতাত করতে দেওয়া হবে না। ফলে ওভার ইনভয়েসিং করার বা চালানপত্রে পণ্যের দাম বেশি দেখানোর সুযোগ থাকবে না। এ প্রক্রিয়ায় অসাধু আমদানিকারকদের বিদেশে অর্থ পাচারের সুযোগও কমে আসবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে পণ্য সেবার সরবরাহ বৃদ্ধি করবে সরকার। এজন্য ব্যাংকগুলোতে এলসি বা ঋণপত্রের অর্থ পরিশোধের সময়সীমা বর্তমান সময়ের তুলনায় আরও কমিয়ে আনা হবে, যাতে আমদানিকারকরা মজুতের সময় না পায় এবং আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্য দ্রুত বাজারে চলে যায়। এ প্রক্রিয়ায় প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বাজারে ছাড়ার সুযোগও কমে আসবে।
এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর সর্বতো উদ্যোগ নেওয়া হবে। এজন্য সরকার বাজেটারি পদক্ষেপের মাধ্যমে কৃষি খাতে সার, বীজ, সেচে ও যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখবে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ নীতিমালার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণও বাড়ানো হবে। প্রকৃত কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছানো নিশ্চিত করা হবে। অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষার আওতাও বৃদ্ধি করা হবে। বিশেষ করে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস, ভিজিডি, ভিজিএফ) আওতা এবং ভর্তুকি মূল্যের কার্যক্রমে বাজেটে ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়ানো হবে। একই উদ্দেশ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, টিসিবি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ, প্রতিযোগিতা কমিশনকে এসব ক্ষেত্রে করণীয় সব ধরনের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের পর্যালোচনা বলছে, ডলারের বাড়তি দামও দেশে মূল্যস্ফীতির জন্য অনেকাংশে দায়ী। তাই ডলারের মজুত বাড়াতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স আহরণ বৃদ্ধির মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপে রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে অনুৎপাদনশীল খাতে সরকারি ব্যয় কমাতে আগামী অর্থবছর ফের আরও কঠোর নির্দেশনা দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে কৌশলগুলো প্রয়োগ করতে চায়, সময়ের চাহিদা বিবেচনায় সেগুলো সঠিকই আছে। তবে আমি মনে করি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে নির্দিষ্ট মাত্রায় স্থির রাখার চেষ্টা আরও বেশি জরুরি। যাতে মানুষ কষ্ট না পায়। এজন্য রিজার্ভ বাড়ানোর ওপরই বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। একই সঙ্গে সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিও দূর করতে হবে। বিশেষ করে কেন মূল্যস্ফীতি বেশি হচ্ছে, তার কারণ আগে জানতে হবে। তার ওপর ভিত্তি করে করণীয় ঠিক করতে হবে। বাজেটারি ব্যবস্থা ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে এ কৌশলগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি।
অন্যদিকে, সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সম্প্রতি প্রকাশিত তার এক মন্তব্য কলামে দাবি করেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অব্যাহত অগ্রগতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, বাণিজ্য বৃদ্ধি, উৎপাদন বৃদ্ধি, ভোগ চাহিদা, সরকারি ব্যয় ইত্যাদি বৃদ্ধির মাধ্যমে এ দেশ নিম্নআয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। এ অগ্রযাত্রা এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু বর্তমান মূল্যস্ফীতি তথা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ উন্নয়নের ফল ভোগ করতে পারছে না। অনেকের কাছে এ উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে পড়ছে। সেজন্য সরকার, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ, রাজনীতিক-সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় মূল্যস্ফীতির প্রকোপ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।