ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ব্যবস্থাপনায় পাঁচ সদস্যের বোর্ড গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ খবরে কিছুটা আশার আলো দেখছেন ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করা লাখ লাখ গ্রাহক। তবে ইভ্যালি কি আবার স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা পরিচালনায় ফিরতে পারবে নাকি প্রতিষ্ঠানটি অবসায়ন হবে- এসব প্রশ্নও জেগেছে গ্রাহকদের মাঝে। এ বিষয়ে গঠিত বোর্ডের চেয়ারম্যান, আইনজীবী ও ইভ্যালির গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিষয়টি অনেকটা নির্ভর করছে ইভ্যালি নিয়ে অডিট রিপোর্টে কি উল্লেখ করা হবে তার ওপর। অর্থাৎ ইভ্যালির ভাগ্য নির্ভর করছে অডিট রিপোর্টের ওপর।
এদিকে, ইভ্যালির প্রতারিত গ্রাহকরা বোর্ড গঠনের খবরে আশান্বিত হলেও তারা চাচ্ছেন কারাগারে থাকা প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলকে বোর্ডে রেখেই সব কিছু পরিচালনা করা হোক।
তারা মনে করছেন, ইভ্যালির মালিক তিনি, তিনিই ভালো জানেন ইভ্যালি কীভাবে চালাতে হবে। তবে বোর্ডের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলছেন, গ্রাহকদের এ চাওয়া পূরণ করা সম্ভব নয়। কারণ কারাগারে থাকা রাসেলকে বোর্ডে রাখার কোনো সুযোগ নেই। মহামান্য হাইকোর্ট পাঁচ সদস্যের বোর্ড গঠন করে দিয়েছেন।
বোর্ড গঠনের পর ইভ্যালির ভবিষ্যৎ কি হবে বা কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে জানতে চাইলে ইভ্যালির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগকারী ভুক্তভোগীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার এএম মাসুম বলেন, কোর্টের আদেশটি পাওয়ার পর বোর্ড তাদের কাজ শুরু করবে। শুরুতেই বোর্ড ইভ্যালির সার্বিক পরিস্থিতি, দায়-দেনার পরিমাণ হিসাব, কত অর্থ তাদের কাছে ভোক্তাদের পাওনা, তাদের কত সম্পদ আছে, গেটওয়েতে কত টাকা, কোন ব্যাংকে তাদের কত টাকা আছে এই পুরো বিষয়টা অর্থাৎ কোম্পানিটি কী অবস্থায় আছে সেটার একটা খতিয়ান করবে। এ ছাড়া ইভ্যালির এমডি বা চেয়ারম্যান কোনো টাকা পাচার করবে কি না সেটিও দেখবে বোর্ড। এ জন্য শুরুতেই অডিট করবেন তারা। অডিট সম্পন্ন করে বোর্ড আগামী ২৩ নভেম্বর আদালতে রিপোর্ট দাখিল করবে।
তিনি বলেন, অডিট রিপোর্টে যদি দেখা যায় ইভ্যালির দায়-দেনা আসলেই অনেক বেশি বা অর্থ পাচার করেছে তা হলে হয়তো কোম্পানি অবসায়ন করা হতে পারে। আর যদি সব কিছুতে ভারসাম্য থাকে তা হলে হয়তো আবার ইভ্যালি চালু করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে। তবে আমি মনে করি, বোর্ডর প্রথম লক্ষ্য থাকবে ইভ্যালিকে আবার চালু করা এবং প্রতারিত গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়া বা পণ্য বুঝিয়ে দেওয়া।
গ্রাহকরা টাকা ফেরত পাবেন কি না সেটিও নির্ভর করছে অডিট রিপোর্টের ওপর। আমরা বিভিন্ন সময় শুনতে পারছি, ইভ্যালি গ্রাহকের ১ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে, কখনও শোনা যাচ্ছে ৭০০ কোটি, কখনও ৬০০ কোটি টাকার কথাও শোনা যাচ্ছে। আসলেই তারা কত টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে নিয়েছে সেটিও উঠে আসবে অডিট রিপোর্টের ওপর। অর্থাৎ ইভ্যালি কি অবসায়ন হবে নাকি চলবে সেটি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে অডিট রিপোর্টের ওপর।
ইভ্যালির বিষয়ে ওঠা প্রতারণার অভিযোগ ও পরিচালনার নিয়ম পর্যালোচনা করতে গত সোমবার বোর্ড গঠন করে দেন বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ। গঠন করে দেওয়া এই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করবেন ওএসডিতে থাকা অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন।
বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন— স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ রেজাউল আহসান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফখরুদ্দিন আহম্মেদ ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ।
ইভ্যালির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, আদালতের আদেশের কপি আমরা এখনও পাইনি। কপি হাতে পেলে কাজে নেমে পড়ব। তবে এ মুহূর্তে যেটা বলতে পারি তা হলো ইভ্যালিকে কার্যকরী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দাঁড় করানো হবে আমাদের প্রথম কাজ। তিনি আরও বলেন, আমার সঙ্গে আরও চারজন সদস্য আছেন। সবার সঙ্গে আলাপ করে ইভ্যালিকে কার্যকরী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার পাশাপাশি যারা টাকা-পয়সা দিয়েছেন তাদেরকে তা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
বোর্ড গঠনের বিষয় নিয়ে ইভ্যালির প্রতারিত গ্রাহকরা কি ভাবছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইভ্যালির গ্রাহক ও বাংলাদেশ ই-কমার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাকিব বলেন, মহামান্য হাইকোর্ট যে বোর্ড গঠন করে দিয়েছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। তবে আমরা চাই ইভ্যালির এমডি রাসেলকে মুক্তি দিয়ে তাকেও বোর্ডে রাখা হোক। কারণ ইভ্যালি কীভাবে চালাতে হয় সেটি তার চেয়ে অন্য কেউ ভালো জানেন না। তবে আমরা আশা করছি বোর্ড তাদের কার্যক্রম শেষ করার পর এবং অডিট রিপোর্ট পাওয়ার পর আমাদের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
জানা যায়, গত ১২ অক্টোবর ইভ্যালি পরিচালনার জন্য কমিটি করে দেওয়ার কথা বলেন হাইকোর্ট। ওইদিন একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও একজন আইনজীবীকে কমিটিতে রাখার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন আদালত। ইভ্যালির দুই কর্ণধার কারাগারে থাকায় এ বোর্ড বা কমিটি গঠন করতে আদেশ দেন আদালত।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক আদেশে ১২ অক্টোবরের মধ্যে ইভ্যালির নথিপত্র আদালতে দাখিল করতে রেজিস্টার জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। সে অনুযায়ী নথি দাখিল করা হয়। এর আগে এক গ্রাহকের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে ২২ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির সব ধরনের সম্পদ বিক্রি এবং হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই আদেশের ধারাবাহিকতায় ৩০ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির সব ধরনের নথি তলব করা হয়।
আবেদনকারী ইভ্যালিতে গত মে মাসে একটি ওয়াশিং মেশিন অর্ডার করেন। অর্ডারের সময় তিনি অর্থ পরিশোধ করেন মোবাইল ফোনভিত্তিক ডিজিটাল আর্থিক সেবার মাধ্যমে। এরপর কোম্পানিটি অনলাইনে তাকে একটি পণ্য কেনায় ৩৩ হাজার ৩০৮ টাকার রসিদও দেয়।
কিন্তু এতদিনেও তারা পণ্যটি বুঝিয়ে দেয়নি। পণ্য বুঝে পেতে আবেদনকারী যোগাযোগ করলে তাকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হয়, কিন্তু পণ্য বুঝিয়ে দেয়নি কিংবা টাকাও ফেরত দেয়নি। পরে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ই-ক্যাব, ভোক্তা অধিকারে কয়েকবার অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে তিনি উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন এবং হাইকোর্টে কোম্পানিটির অবসায়ন চেয়ে আবেদন করেন। ওই গ্রাহক ইভ্যালি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠনেরও আবেদন জানান।
আবেদনে ইভ্যালি লিমিটেড, রেজিস্টার জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, কনজুমার রাইটস প্রটেকশন ব্যুরো, নগদ, বিকাশ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, ই-ক্যাব অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বেসিস, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য সচিবকে বিবাদী করা হয়।
এ আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে গত ২২ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ইভ্যালিকে কেন অবসায়ন করা হবে না, তা জানতে চান আদালত। এ জন্য একটি নোটিস ইস্যু করা হয়েছিল।