শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে সম্মেলন পার করার কৌশল

প্রকাশিত: ১২:২৭ পিএম, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২১

আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে সম্মেলন পার করার কৌশল

আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত রাজনীতির মাঠ নিজেদের দখলেই রাখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে দলের ২২তম কাউন্সিলের প্রস্তুতি ও নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে কর্মসূচি তৈরি করা হচ্ছে। তবে জেলা, উপজেলা ও থানা কমিটির দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে বেশি চাপে রয়েছে দলটি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো নিয়ে হিমশিম অবস্থা তাদের। দলীয় সভাপতির নির্দেশনা অনুযায়ী দ্রুত সময়ের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোর সম্মেলনের ওপর জোর দেওয়া হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। তাই বিশৃঙ্খলার সমাধান করতে নতুন কৌশলের দিকে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, কেন্দ্রের নির্দেশনা আর মাঠের চিত্র এক নয়। টানা তিনবার দল ক্ষমতায় থাকায় সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাভোগীদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের বিরোধে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। ফলে বিরোধপূর্ণ সাংগঠনিক জেলা ও উপজেলায় নতুন কমিটি দিতে গেলে শৃঙ্খলা আরও ভেঙে পড়তে পারে। তবে কাউন্সিলের আগে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোর সম্মেলন করতে। কিন্তু যেখানে বেশি বিরোধ সেখানে সম্মেলন পর্যন্ত আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চালানোর বিষয় ভাবছে দল। আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অনেক চেষ্টার পরও সাধারণ সম্পাদকের এলাকা নোয়াখালীর বিরোধ মেটানো যাচ্ছে না। গত বুধবার নোয়াখালীর বিষয় নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে আহ্বায়ক কমিটি করে সামনে এগোনোর বিষয়টি উঠে আসে। সম্মেলনের আগে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা চায় না দল।’ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, অন্ততপক্ষে জেলা, উপজেলা ও থানা কমিটির ৭০টির বেশি জায়গায় স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে এমপিদের দ্বন্দ্ব। আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘বুধবার বিভাগীয় টিমের মিটিংয়ে নোয়াখালীর বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। মিটিংয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির কাউন্সিল করা, বিদ্যমান দ্বন্দ্ব/বিভেদ নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে সাংগঠনিক সফর করা হবে এবং বিভিন্ন নেতাকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনা করে সংকট নিরসন করা হবে। আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কমিটি করব।’ ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে অধ্যক্ষ এএইচএম খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিমকে সভাপতি ও একরামুল করিম চৌধুরী এমপিকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। এরপর ওই বছরই ৭৫ সদস্যের প্রস্তাবিত কমিটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখনো পর্যন্ত সেই কমিটি অনুমোদন হয়নি। এরই মধ্যে এ কমিটি নিয়ে কেন্দ্রে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়ে। এদিকে বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা ও এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। কাদের মির্জা ও একরামুল চৌধুরীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে জেলা আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। আট বিভাগে আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৪৩টিতে এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১৫টি, চট্টগ্রামের সাতটি, ময়মনসিংহের পাঁচটি, রাজশাহীর চারটি, বরিশালের চারটি, রংপুরের তিনটি, খুলনার চারটি এবং সিলেট বিভাগের একটি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। অন্যদিকে সারা দেশে উপজেলা, থানা ও পৌর কমিটির সংখ্যা প্রায় ৬৫০টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৬০টি, চট্টগ্রামে ১২৯টি, রাজশাহীতে ৮৩টি, খুলনায় ৭৪টি, রংপুরে ৬৬টি, বরিশালে ৫৩টি, সিলেটে ৪৯টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৯টির মতো কমিটি রয়েছে। এসব কমিটির মধ্যে এখনো ৩৫৭টি কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। কোথাও কোথাও ২০-২২ বছরেও সম্মেলন হয়নি। কয়েক হাজার ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও ইউনিট কমিটির মধ্যে ঠিক কতগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ, সেই পরিসংখ্যান দলের কাছেও নেই। এছাড়া সম্মেলন হওয়া কমিটির অর্ধেকের বেশি পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। গত ৯ সেপ্টেম্বর গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোর সম্মেলন দ্রুত শেষ করার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সারা দেশে দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসন করে তৃণমূল চাঙ্গা করা, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ, ইশতেহার প্রণয়ন, সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ নানা নির্দেশনা দেন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের বসে যেখানে যেখানে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল আছে তা দ্রুত নিরসনের নির্দেশনা দেয় দলের হাইকমান্ড। ২০১৯ সালের ২০-২১ ডিসেম্বর দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগে-পরে ৩৫টি জেলা এবং ১৯৩টির মতো উপজেলা, থানা ও পৌর কমিটির সম্মেলন হয়। করোনার কারণে গত বছরের ৮ মার্চ থেকে তৃণমূলে সম্মেলন বন্ধ হয়ে যায়। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত ১০ ডিসেম্বর জয়পুরহাট জেলার সম্মেলন হয়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে তৃণমূল সম্মেলনসহ জনসমাগমের কর্মসূচি বন্ধ রাখা হয়। বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ ৪৩টি জেলায় তিন বছরের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে এক থেকে পাঁচ বছর আগে। আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সবুর বলেন, ‘নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তত বেশি গুজব অপপ্রচার ছড়ানোর চেষ্টা করবে। যেহেতু তারা রাজপথে পেরে উঠতে পারবে না, তাই তাদের একমাত্র হাতিয়ার গুজব-অপপ্রচার। আমাদের আগামী দিনে এই গুজব-অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সারা দেশে ইতিমধ্যে ৬৯টি কর্মশালা সম্পন্ন করেছি। আমাদের লক্ষ্য জেলা পর্যায়ে ১০ হাজার মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা। আর এই মাস্টার ট্রেইনারদের দ্বারা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এক লাখ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরি করা হবে। আমরা মনে করি একটি বড় দলে ছোটখাটো যে দ্বন্দ্ব রয়েছে তার সমাধান হবে।’ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সব সময়ই রাজনীতির মাঠে আছে। আমরা কাউন্সিল ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে আছি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক এবং দলীয় কর্মকা- চলবে।’
Link copied!