শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ই-কমার্স প্রতারণার দায় কোন মন্ত্রণালয়ের

প্রকাশিত: ১১:০৩ এএম, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২১

ই-কমার্স প্রতারণার দায় কোন মন্ত্রণালয়ের

একের পর এক বেরিয়ে আসছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ঘটনা। সম্প্রতি ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য না দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করেছে ক্রেতার সঙ্গে। এখন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর এই প্রতারণার দায় নিতে চাচ্ছে না কোনো মন্ত্রণালয়। খোদ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায় চাপিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর। আর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলছেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিককে জেলে নেওয়া কোনো সমাধান নয়। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দুই মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি দেখা দেবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। এদিকে গতকাল বিকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চার মন্ত্রীর বৈঠকে ই-কমার্স নিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য ই-কমার্স কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে, ই-কমার্স নিয়ে স্বতন্ত্র আইন করা হবে এবং প্রতারিত গ্রাহকরা কীভাবে টাকা ফেরত পেতে পারেন সে ব্যাপারে পন্থা বের করা হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ক্রয় কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণার দায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান করার সময় কারও না কারও ছাড়পত্র নিয়েই করা হয়েছে। এখানে ছাড়পত্র দিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকভাবে তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। এর সঙ্গে অন্য যাদের সম্পৃক্ততা আছে, তাদের সবারই দায়িত্ব নেওয়া উচিত। এ বিষয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, মূলত কাজটি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা আছে। তারা এসব বিষয় নিয়ে আসে আমাদের এখানে। আইটির বিষয় আছে, সেখানে আইসিটি মিনিস্ট্রি আছে, তারাও দায়িত্ব নেবে। মাঝেমধ্যে তৈরি হওয়া এসব প্রতিষ্ঠান মানুষকে ঠকায়। এটা কিন্তু চলে আসছে। আগে যেভাবে হতো, সেটি এখন ভিন্ন আঙ্গিকে আসছে। আগে ম্যানুয়ালি করত, এখন ইলেক্ট্রিক্যালি করছে। ডিজিটালাইজড ওয়েতে করা হচ্ছে। সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে অবশ্যই। সরকারই দায়িত্ব নেবে। সরকার দায়িত্ব এড়াবে কেন? এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ইভ্যালির সিইও ও চেয়ারম্যানকে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হচ্ছে, এটা তো সমাধান নয়। গ্রাহকরা যেন তাদের টাকা ফেরত পান, আবার অভিযুক্তরাও যেন শাস্তি পান, উভয় বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে সরকার। আমরা সার্বিক বিষয়ে অবজার্ভ করছি। আমরাসহ চার মন্ত্রণালয় (অর্থ, বাণিজ্য, আইন ও স্বরাষ্ট্র) বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি। তাদের অবস্থান নির্ণয় করা হচ্ছে। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন  বলেন, প্রথম বিষয় হলো- বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চার মন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলো খুবই যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী। ই-কমার্স কর্তৃপক্ষ গঠনের এবং ই-কমার্স আইন করার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে দ্রুত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং অন্য দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। এটা খুবই সময়োপযোগী উদ্যোগ। দ্বিতীয়ত, একই দিন ই-কমার্স নিয়ে সরকারের অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী দুজনে দুরকম কথা বলেছেন। আমি মনে করি, ই-কমার্স সংক্রান্ত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সব মন্ত্রণালয়ের একটি কমন অবস্থান থাকা উচিত। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দ্বারা ভোক্তা প্রতারিত হয়েছে এবং এখানে অবৈধ বাণিজ্য হয়েছে- এসব বিষয়ে একমত অবস্থান থাকা দরকার। এই সময়ে একেক মন্ত্রীর একেক ধরনের কথা ভিত্তি বা আস্থার জায়গাটা দুর্বল করে দেয়। যারা দোষী তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব জায়গায় সবাইকে সমানভাবে দেখা দেওয়া উচিত। একেক জনকে দোষারোপ না করে সবাইকে নিয়ে আইনি কাঠামো গঠনে যৌথভাবে কাজ করা এবং সবার সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাজগুলো করা জরুরি। এই সময় একে অপরের ওপর দায় চাপালে কর্তৃপক্ষ গঠন প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যাবে, একইভাবে আইনি কাঠামোর প্রক্রিয়াতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে  বলেন, ই-কমার্স নিয়ে সরকারের একেক মন্ত্রী এখন একেক রকম কথা বলছেন, একেকজন অন্যের ওপর দায় চাপাচ্ছেন- এটা তো কোনোভাবে কাম্য নয়। আমি মনে করি, সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্সের নামে সাধারণ মানুষের অর্থ যেভাবে লুটপাট হয়েছে, তার দায় অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়- কেউই দায় এড়াতে পারে না। এতদিন ধরে এসব প্রতিষ্ঠান দিনের আলোতে প্রকাশ্যে মানুষের অর্থ লুটে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ অর্থ মন্ত্রণালয় কিংবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছুই জানে না- এটা মানা যায় না। তারা কি এতদিন ঘুমিয়ে ছিল। এখন পরিস্থিতি যেহেতু ঘোলাটে হয়ে গেছে, লাখ লাখ মানুষের টাকা লুট করা হয়ে গেছে- এ রকম পরিস্থিতিতে একে অপরের প্রতি দোষ না চাপিয়ে সবার আগে যে কাজটি করা দরকার সেটি হচ্ছে- যেসব সাধারণ মানুষের টাকা লুট করা হয়েছে তাদের সে অর্থ কীভাবে দ্রুত ফেরত দেওয়া যায় সে ব্যবস্থা করা। কারণ বেশি দেরি হয়ে গেলে এসব বিষয় ঝিমিয়ে যায়, তখন আর টাকা ফেরত পান না প্রতারিতরা। এরপর ই-কমার্স কর্তৃপক্ষ করা বা স্বতন্ত্র আইন করা। কিন্তু সবার আগে যেন সাধারণ মানুষের অর্থ ফেরত দেওয়া যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, অর্থমন্ত্রী দায় চাপাচ্ছেন বাণিজ্যমন্ত্রীর ঘাড়ে কিন্তু অর্থমন্ত্রীও তো এর দায় এড়াতে পারেন না। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকও এর দায় এড়াতে পারে না। বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের অর্থ লুট করে নিল কিন্তু সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান এগুলো টের পেল না- এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়। গণমাধ্যমে রিপোর্ট আসার পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা জানতে পেরেছে। এখন হয়তো তারা বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তো আগে থেকেই বিষয়টি জানা দরকার ছিল। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা শুরু করার আগে অবশ্যই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো সংস্থার অনুমতি নিয়েই ব্যবসা শুরু করেছে। তাহলে যখন তাদের অনুমতি দেওয়া হলো তখন তাদের কোন ধরনের ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হলো এবং পরে তারা সে ধরনের ব্যবসা করছে নাকি অন্য কিছু করছে সেগুলো তো এসব সংস্থার তদারক করা দরকার ছিল। আমার তো মনে হয়, এ ধরনের কোনো তদারক হয়নি, হলে এতগুলো প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিতে পারত না।
Link copied!