সরকারি গুদামে এই মুহূর্তে খাদ্যশস্যের মজুদ ১৯ লাখ ৭৮ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুদই ১৬ লাখ ৯ হাজার টন। চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে (১ জুলাই থেকে ১৬ জানুয়ারি) বিভিন্ন দেশ থেকে মোট খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছে ২৯ লাখ ১৫ হাজার টন। এর মধ্যে চাল আমদানি করা হয়েছে ৮ লাখ ৭৬ হাজার টন, বাকিটা গম। চলতি বোরো মৌসুমেও দেশে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে, তার আগে বোরো মৌসুমেও ফলন হয় বাম্পার। অর্থাৎ এত চাল থাকার পরও বাজারে দাম কমছে না দেশের মানুষের প্রধান এই খাদ্য পণ্যটির। এতে চরম সঙ্কটে আছে সাধারণ মানুষ।
এদিকে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও খাদ্য অধিদফতরের ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেলস) কার্যক্রম সারা দেশে ব্যাপক হারে চালু করা হয়নি। এখনও পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীতেই সীমিত আকারে ওএমএস কর্যক্রম চালু রয়েছে। ঢাকায় মাত্র ২০টি ট্রাকে করে ওএমএস চাল ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। যদিও খাদ্য সরকার কাবিখা, ভিজিডির মতো কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের হাতে চাল তুলে দিচ্ছে, কিন্তু তাতে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে আসছে না। এ অবস্থায় সারা দেশে ব্যাপক হারে ওএমএসের চাল বিক্রি শুরু করার পরামর্শ দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, চালের দাম না কমার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে মিলমালিক ও বড় বড় পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের কারসাজি। কারণ কোনো একটি মিল বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের গুদামে গেলে দেখা যাবে শত শত বস্তা চালের মজুদ। অনেক সময় চাল মজুদ করে রেখে বাজারে সরবরাহ ছাড়ে কম করে। ব্যবসায়ীদের এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারে একমাত্র সরকারের খাদ্য বিভাগ। তারা যদি খোলা বাজারে ব্যাপকহারে ওএমএসের চাল বিক্রি শুরু করে তা হলে এর প্রভাব বাজারে পড়তে বাধ্য। তিনি বলেন, সরকারের আরও একটি কাজ করার আছে- কোন মিলে কি পরিমাণে ধান-চাল মজুদ রয়েছে তার তথ্য বের করা। এতে মাঠ পর্যায়ে চালের মজুদ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারবে এবং কোনো মিলমালিক অতিরিক্ত ধান-চাল মজুদ করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে। অর্থাৎ সরকারের কঠোর অবস্থান না নেওয়া পর্যন্ত চালের দাম কমবে না। অথচ দেশে যে পরিমানে ধান-চালের মজুদ রয়েছে এবং যে হারে আমদানি হচ্ছে তাতে চালের বাজার এত চড়া থাকার কথা না।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত সরকারি খাদ্য গুদামে মোট খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে ১৯ লাখ ৭৮ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৬ লাখ ৯ হাজার টন, গম ৩ লাখ ৪৪ হাজার টন এবং ধান ৩৮ হাজার টন।
চালের আমদানি পরিস্থিতিও বেশ ভালো এখন। গত ৬ মাসে দেশে মোট খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে ২৯ লাখ ১৫ হাজার ৩০ টন। এর মধ্যে গম আমদানি হয়েছে ২০ লাখ ৩৮ হাজার টন এবং চাল আমদানি হয়েছে ৮ লাখ ৭৬ হাজার টন। যে চাল আমদানি হয়েছে এর মধ্যে সরকারি উদ্যোগে আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৯৪ হাজার টন এবং বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজার টন। এ ছাড়া গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য আমদানি করা হয় ৬৭ লাখ ১ হাজার ৯৬ টন। এর মধ্যে গম আমদানি হয়েছে ৫৩ লাখ ৪২ হাজার টন এবং চাল আমদানি হয়েছে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন। অর্থাৎ খাদ্যশস্য আমদানি পরিস্থিতিও খারাপ না। কিন্তু কোনো প্রভাবেই কমছে না চালের দাম।
আমনের ভালো ফলন আর সবশেষ বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনের রেকর্ড হলেও রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পুরনো চালের দাম কেজিতে অন্তত দুই টাকা করে বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক মাসে সব ধরনের চালের দাম গড়ে ৩ শতাংশ করে বেড়েছে। এক বছর আগের তুলনায় সরু চালের দাম বেড়েছে ৮ শতাংশ। বাজারে এখন ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৭৫-৭৮ টাকায়। এ ছাড়া বিআর২৮ হিসেবে পরিচিত মধ্যম মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৬০-৬২ টাকায়। মাঝারি আকারের পাইজাম চালের দাম প্রতিকেজি ৫৫ টাকা এবং মোটা চাল কেজি এখন ৫০-৫২ টাকা।
কারওয়ান বাজারে জনতা রাইস এজেন্সির বিক্রেতা মোহাম্মদ রাসেল বলেন, গত এক মাস ধরে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের বাজার বেশি বাড়তি। এ দুটো চালের ৫০ কেজির বস্তা ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাজারে মিনিকেট চালের বস্তা এখন তিন হাজার টাকার নিচে নেই। এ দোকানের মূল্য তালিকায় দেখা যায়, মাঝারি মানের মিনিকেট চাল প্রতিকেজি ৫৮-৬০ টাকা, ভালো মানের মিনিকেট ৭৫ টাকা, মাঝারি মানের নাজিরশাইল ৬০-৬৫ টাকা, ভালো মানের নাজিরশাইল ৭৫ টাকা। বিআর২৮ চাল থেকে ৬০ টাকা, পাইজাম ৫৫ টাকা, চিনিগুঁড়া ৭৬-৮৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকায় ডি-৮ সম্মেলন উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে চালের দাম নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, চালের উৎপাদন প্রতিবছর বাড়ছে। বাজারে চালও আছে ‘পর্যাপ্ত’, কিন্তু দাম কমছে না। তিনি বলেন, সরকারি হিসেবে দেশে খাদ্যের মজুদও সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৩ লাখ টন আমন ধান এবং ৫ লাখ টন সিদ্ধ আমন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৪০ হাজার টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক আরও জানিয়েছিলেন, গত বোরো মৌসুমে (২০২০-২১ অর্থবছর) ২ কোটি ৮ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একই সময়ে সব ধরনের খাদ্যের উৎপাদনও বেড়েছে। মোটা চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন, গম ১২ লাখ টন, ভুট্টা ১৭ লাখ টন, আলু ১ কোটি ৬ লাখ টন এবং পেঁয়াজের উৎপাদন ১ লাখ টন বেড়ে ৩৩ লাখ টন হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতেও চালের দাম বাড়ছে কেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধির বৈশি^ক কারণ ছাড়াও একটা বড় কারণ হচ্ছে সম্প্রতি গমের দাম বেড়ে যাওয়া। গমের দাম বাড়লে চালেরও দাম বাড়ে। এখন গমের দাম চালের চেয়েও বেশি। যখন আটার দাম কম থাকে তখন মানুষ আটা খায়। এখন আটার দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষ আটা খাওয়া ছেড়ে দিয়ে চাল খাওয়া শুরু করেছে। এ জন্য চালের দাম বেশি।