শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে প্রণোদনার ঋণ নিয়ে বড় জালিয়াতি,প্রতারনা

প্রকাশিত: ১০:০৬ এএম, অক্টোবর ২৮, ২০২১

করোনাকালে প্রণোদনার ঋণ নিয়ে বড় জালিয়াতি,প্রতারনা

ডেইলি খবর ডেস্ক: ই-কমার্স প্রতারকের চেয়েও ভয়ঙ্কর প্রতারনা।দেশে করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া প্রণোদনার ঋণ নিয়ে বেশকিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান বড় জালিয়াতি করেছে,প্রতারনা করেছে। তারা শর্ত ভঙ্গ করে কম সুদে ঋণ নিয়ে বেশি সুদের ঋণ পরিশোধ করেছে।এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোও সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের বেআইনি কর্মকান্ডে সহায়তা দিয়েছে। এছাড়া প্রণোদনার ঋণ মূল হিসাব থেকে ৪/৫ দফা স্থানান্তরের পর নগদ আকারে তুলে নেওয়ার ঘটনাও আছে। এসব অর্থ অণ্যের নামে পে-অর্ডার করে স্থানান্তর হয়েছে।এ খাতের অনেক টাকা কোথায় কীভাবে নেওয়া হয়েছে, এর কোনো হদিস মিলছে না। প্রণোদনার ঋণ অপব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জানা যায়,কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮টি পরিদর্শন বিভাগ ও ৮টি শাখা অফিস থেকে এসব তদন্ত হয়েছে। এ তদন্তে সিসিটিভির ফুটেজও ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম,বরিশাল,রাজশাহী বগুড়া,খুলনা, ময়মনসিংহ,রংপুর ও সিলেট অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থিত ব্যাংকের শাখাগুলোয়ও তদন্ত হয়েছে। প্রণোদনার ঋণের অর্থ অপব্যবহার হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণে এমন তথ্য উঠে এলে তারা তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়।এছাড়া পরে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি যৌথ পরিকল্পনার মাধ্যমে সারা দেশে একযোগে তদন্ত শুরু করে। এসব তদন্ত প্রতিবেদন সমন্বয় করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। উল্লেখ্য,করোনার প্রকোপ শুরু হলে গত বছরের এপ্রিল থেকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এখন পর্যন্ত ২৩টি প্যাকেজের আওতায় দুই দফায় আড়াই লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হয়। এর মধ্যে ঋণনির্ভর প্রণোদনাই প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। বাকি টাকা অন্যান্য খাতের জন্য বরাদ্দ হয়।প্রণোদনার শর্ত অনুযায়ী ঋণের টাকা শুধু চলতি মূলধন হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের’প্রণোদনার তহবিল থেকে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পে মেয়াদি ঋণ দেওয়া যাবে। কিন্তু কোনো প্রণোদনার অর্থেই আগের ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। একই সঙ্গে কোনো খেলাপি গ্রাহককে ঋণ দেওয়া যাবে না। প্রণোদনার টাকা স্বচ্ছভাবে ব্যবহার করতে হবে। এসব অর্থ কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে, তা কঠোরভাবে তদারকি করার নির্দেশ দেওয়া হয় ব্যাংকগুলোকে। কিন্তু ব্যাংক এবং প্রণোদনার ঋন গ্রহীতাদের একটি বড় অংশই এসব শর্ত মানেনি।প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। ঋণের বাকি ৫ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভর্তুকি হিসাবে দিচ্ছে। এ ঋণ নিয়ে ৯-১৪ শতাংশ সুদের আগের বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে বেআইনিভাবে। যারা অনিয়ম করেছে,তারা শর্ত অনুযায়ী প্রণোদনার সুবিধা পাবে না। তাদের ৯ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতে হবে। একই সঙ্গে যেসব ব্যাংক কর্মকর্তা এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত,তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়,প্রণোদনার ঋণ পাওয়ার পর অনেকে অর্থ নগদ আকারে তুলে নিয়ে অন্য গ্রাহকের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে জমা করেছে। ঋণের অর্থ ছাড় হওয়ার পর তা ৪/৫ দফায় বিভিন্ন ব্যাংকের একাধিক হিসাবে স্থানান্তরের পর তা নগদ আকারে তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু গ্রাহক প্রণোদনার অর্থ কোন খাতে নিয়েছেন, এর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গ্যালিকো স্টিল বিডি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৩৩ কোটি টাকা প্রণোদনার ঋণ নিয়ে অন্য ব্যাংকে তার ঋণ বেআইনিভাবে সমন্বয় করেছে। তারা প্রণোদনার ঋণ নিয়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে। এ ঋণ তারা তুলে নিয়ে ক্যাশ ক্রেডিট বা সিসি হিসাবে জমা করেছে। সেখান থেকে নিয়ে গ্রাহকের বেশি সুদের অন্য ঋণ পরিশোধ করেছে। ঋণের বিপরীতে সুদের অর্থও নিয়মিত পরিশোধ করেনি।এলকো ওয়্যার কেমিক্যালস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৩ কোটি টাকা প্রণোদনার ঋণ নিয়ে অন্য ব্যাংকের বেশি সুদের ঋণ শোধ করেছে। ব্যাংক থেকে প্রথমে টাকা তুলে ৩/৪ দফায় টাকা বিভিন্ন ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর করেছে। পরে তা দিয়ে গ্রাহকের অন্য একটি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। ব্যাংক বিষয়টি জানার পরও নীরবতা পালন করেছে। এছাড়া গ্রাহক যে পরিমাণ ঋণ পাবে তার চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংক। কিন্তু বাড়তি এ ঋণ সমন্বয় করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশ দেওয়া হলেও তা করা হয়নি।সিলমো ইলেকট্রোস লিমিটেড নামের এক প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার ঋণ নিয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ঋণ নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাব ঘুরিয়ে গ্রাহকের অন্য ঋণ পরিশোধ করেছে। ওই টাকা তারা প্রথমে নগদ আকারে তুলে নেয়। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটে (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন দিয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী কোনো একক হিসাব থেকে একদিনে ১০ লাখ টাকার বেশি অর্থ নগদ আকারে তোলা হলে বিএফআইইউতে ক্যাশ ট্রানজেকশন রিপোর্ট (সিটিআর) দিতে হয়।প্রণোদনার ঋণ ছাড় হওয়ার পর ১০ লাখের বেশি অর্থ একসঙ্গে তোলার কারণে ব্যাংক বিএফআইইউতে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিয়েছে। তদন্তের সময় পরিদর্শক দল এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে। পরে গ্রাহক সেগুলো নগদ আকারে জমা দিয়ে পে-অর্ডার করেছে। এক্ষেত্রে অন্যের নামে পে-অর্ডার করে সেগুলো জমা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন হিসাবে। এ ঘটনায় ব্যাংকের সিসিটিভির ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যে ব্যক্তি টাকা তুলেছেন, তিনি ওই টাকা জমা দেননি। জমা দিয়েছেন অন্য কোনো ব্যক্তি।পূরবী অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। ঋণের অর্থ তারা প্রণোদনার শর্ত অনুযায়ী ব্যবহার করেছে কি না, সে তথ্য ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলকে দেখাতে পারেনি। বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়াম প্রণোদনা বাবদ ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে একই ব্যাংকে তাদের চলতি হিসাবে স্থানান্তর করেছে। পরে তা নগদ আকারে তুলে নিয়ে অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর করে। এসব অর্থ সংশ্লিষ্ট শিল্প খাতে ব্যবহার করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঋণের মধ্যে ৩ কোটি টাকা নগদ আকারে তুলে ১ কোটি টাকা করে ৩টি পে-অর্ডার করেছে। সেগুলো বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে জমা করেছে। পরে ওইসব অর্থ নগদ আকারে তুলে নিয়েছে। কিন্তু ওখান থেকে ওইসব টাকা কোথায় গেছে, এর হদিস পাওয়া যায়নি। ঋণের মধ্যে আরও ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা তারা নগদ তুলে নিয়েছে।স্টোন ব্রিকস প্রণোদনা বাবদ ৪ শতাংশ সুদে ৯ কোটি টাকা নিয়ে বেশি সুদের অন্য ঋণ বেআইনিভাবে সমন্বয় করেছে।রশিদ ব্রিকস ৮ কোটি টাকা প্রণোদনার ঋণ নিয়ে ৭ কোটি টাকা দিয়েই অন্য ঋণ সমন্বয় করেছে। বাকি ১ কোটি টাকা নগদ তুলে নিয়েছে। এসব টাকা কোথায় গেছে, তদন্তে এর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক তদন্তে দেখা যায়, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে প্রণোদনা বাবদ ৪ শতাংশ সুদে যেসব ঋণ দেওয়া হয় তার একটি বড় অংশই বেশি সুদের অন্য ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রংপুর অফিস থেকে প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ঋণের অঙ্ক ছোট ছোট। বিশেষ করে কৃষি ফার্ম ও অ্যাগ্রো প্রসেসিং শিল্পের উদ্যোক্তারা এসব কর্মকান্ড করেছেন।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিস থেকে পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায় প্রণোদনার অর্থ ব্যবহারে নানা অনিয়ম হয়েছে। বিশেষ করে অনেক গ্রাহক প্রণোদনার কম সুদে ঋণ নিয়ে আগের বাণিজ্যিক ঋণ পরিশোধ করেছেন। এদের সহায়তা করেছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।চট্টগ্রামের বড় একটি শিল্প গ্রুপ প্রণোদনা বাবদ ১০ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তা দিয়ে আগের বাণিজ্যিক ঋণ পরিশোধ করেছেন। প্রণোদনার ঋণের সুদের হার সাড়ে ৪ শতাংশ। আর বাণিজ্যিক ঋণের সুদের হার ১২ শতাংশ।সূত্র জানায়,প্রণোদনার ঋণের অংশ যেগুলো নগদ আকারে বা পে-অর্ডার আকারে নেওয়া হয়েছে সেগুলোর একটি অংশ শেয়ারবাজারে স্থানান্তর হয়েছে। তবে নগদ টাকা ও পে-অর্ডার কোথা থেকে কীভাবে অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে বিষয়ে কোনো তদন্ত করেনি। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান,দ্রæত তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। এজন্য তারা শুধু ৪-৫ ধাপ অর্থ স্থানান্তরের ঘটনা পরিদর্শন করেছেন। এর বেশি অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি।এছাড়া প্রণোদনার অর্থ অপব্যবহারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের সহযোগিতা রয়েছে। যেসব গ্রাহক আগের ঋণ পরিশোধ করেছেন তাদেরকে ব্যাংক কর্মকর্তারা বেআইনিভাবে সহযোগিতা করেছেন। কেননা ব্যাংকাররা চেয়েছেন যে কোনোভাবেই হোক আগের ঋণ পরিশোধ হোক। এতে ব্যাংক ঋণ আদায় দেখাতে পারবে। এ কারণে অনেক ব্যাংক গ্রাহকের প্রণোদনার অর্থ নগদ আকারে তুলে নিয়ে ঋণ শোধের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে,অ্যাসোসিয়েট স্টিল একটি ব্যাংক থেকে ৩ কোটি টাকা প্রণোদনার ঋণ ৩ দফায় বিভিন্ন ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন। পরে তা নগদ আকারে ১ কোটি টাকা করে তিন দিনে তিন কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। সেগুলো অন্য একটি ব্যাংকে নিয়ে ৬টি পে-অর্ডার করেছেন। পরে সেগুলো একই গ্রাহকের ঋণ শোধে জমা দিয়েছেন।সুত্র-যুগান্তর
Link copied!