শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যা দিবস গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: যা করতে হবে হারুন হাবীব

প্রকাশিত: ০৯:০৯ এএম, মার্চ ২৫, ২০২২

গণহত্যা দিবস গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: যা করতে হবে হারুন হাবীব

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় অনুচরদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়কে স্মরণ করে বাংলাদেশ 'গণহত্যা দিবস' পালন করে ২৫ মার্চ। স্মরণ করে সেই নিষ্ঠুর সময়কে, যখন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বর্বরোচিত ও নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে এবং এক কোটি মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ফেলে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। ইংরেজি 'জেনোসাইড' শব্দটি বাংলায় 'গণহত্যা' হিসেবে স্বীকৃত। যার অর্থ বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী বা ধর্ম-বর্ণ ও বিশ্বাসের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত পন্থায় পরিচালিত ব্যাপক হত্যাকান্ড,আক্রমণ ও পীড়ন, যা সেই জনগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। জাতিসংঘের ১৯৪৯ সালের 'জেনোসাইড কনভেনশন'-এ এই সংজ্ঞা স্বীকৃত। সে কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে পাস্তনি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের হাতে যে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ঘটে,তা সব অর্থেই 'গণহত্যা' বা 'জেনোসাইড'। বাংলাদেশের মাটিতে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, তা ছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস গণহত্যা। বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রথম অভিযানটি পরিচালিত হয় ২৫ মার্চ রাতে 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে। এ অভিযানের মধ্য দিয়ে তারা কেবল নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে উৎখাতের পথ বেছে নেয়নি; একই সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্য,পুলিশ, ইপিআর এবং ছাত্র-জনতাকে নিধনের পরিকল্পনা করে।নাজি বাহিনীর হাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পর ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের 'জেনোসাইড কনভেনশন' অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ পরিষদের ২৬০ নম্বর রেজুলেশনে পরে এর অনুমোদন দেওয়া হয়। এরও বহু বছর পর ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে 'আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্ব সংস্থার এ পদক্ষেপ ছিল গণহত্যার ভয়ংকর পুনরাবৃত্তি রোধ করা। এর পরও থামানো যায়নি গণহত্যার মতো নির্বিচার এবং বিশেষ জনগোষ্ঠীকে নিধন করার পরিকল্পিত প্রয়াস। জাতিসংঘ এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রাচীন ও সাম্প্রতিক গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিরোধ-প্রতিবাদ সত্ত্বেও দিয়েছে। স্বীকৃতি দিয়েছে অটোমান টার্কদের হাতে ১৯১৫ সালে ১৫ লাখ আর্মেনীয় হত্যা; ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় ৮ লাখ তুতসি জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজিদের হাতে ইউরোপে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা। এমনকি স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৯২ সালের বসনিয়া ও ১৯৭৫ সালের কম্বোডিয়ার গণহত্যা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে যে ৩০ লাখ বাঙালির পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ ঘটে ১৯৭১ সালে; তার কোনো স্বীকৃতি আজও দিতে পারেনি বিশ্ব সংস্থা! এমন একটি ব্যর্থতা কেবল দুঃখজনক নয়; বিশ্ব সংস্থার চরম ব্যর্থতা ও দৈন্যেরই বহিঃপ্রকাশও বটে। শুধু তাই নয়; এমন ব্যর্থতার যুক্তিসংগত কারণও দেয়নি জাতিসংঘ। অথচ বিশ্ববাসী জানে, ১৯৭১ সালের ৯ মাসে পাকিস্তনি সৈন্য ও তাদের দোসরদের হাতে বাংলাদেশের মাটিতে যে গণহত্যা চলে, তা ছিল ২০ শতকের নৃশংস গণহত্যাগুলোর অন্যতম। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, যে পরিকল্পিত বর্বরতায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং যার বিস্তাারিত বিবরণ বা ডকুমেন্টেশন গোটা বিশ্বেই আছে; যে বর্বরতায় নির্বিচারে নারী ধর্ষণ করা হয়েছে, মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, নদী-খাল-বিলে ভেসে থেকেছে গলিত শব, সেই বর্বরতার স্বীকৃতি জাতিসংঘ থেকে ৫১ বছরেও মেলেনি!জাতিসংঘের সেদিনকার মহাসচিব উথান্ট ৩ জুন ১৯৭১ সালে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন এই বলে :'দ্য হ্যাপেনিংস ইন ইস্ট পাকিস্তান কনস্টিটিউট অন অব দ্য মোস্ট ট্র্যাজিক এপিসোডস ইন হিউম্যান হিস্টোরি। অফকোর্স, ইট ইজ ফর ফিউচার হিস্টোরিয়ান টু গ্যাদার ফ্যাক্টস অ্যান্ড মেক দেয়ার ওন ইভালুয়েশন, বাট ইট হ্যাজ বিন এ ভেরি টেরিবল বøট অন এ পেজ অব হিউম্যান হিস্টোরি।'বিশ্ব সংস্থা এর পরও বাঙালির ওপর চালিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এই গণহত্যার জোরালো স্বীকৃতি আছে বিশ্বজোড়া সংবাদপত্র,প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও হাজারো প্রামাণ্যচিত্রে। দেশ-বিদেশে শত শত বই লেখা হয়েছে বিংশ শতাব্দীর এই নৃশংসতম গণহত্যা নিয়ে। হয়েছে গবেষণা, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে ২০২১ সালে। এই উদযাপনকালেই গণহত্যা গবেষণা বিষয়ক অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান 'লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন' গুরুত্বপূর্ণ একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সে বিবৃতিতে বলা যায়,প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোনো প্রতিষ্ঠান জোরালোভাবে বাঙালি গণহত্যার বিচার দাবি করেছে এবং জাতিসংঘকে এই গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে দাবি জানিয়েছে। লেমকিন ইনস্টিটিউটের বিবৃতির শেষাংশটি এ রকম :'গিভেন দ্য ল্যাক অব বোর্ড ইন্টারন্যাশনাল রিকগনিশন দি লেমকিন ইনস্টিটিউট কলস আপন দি ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি, ইনক্লুডিং দ্য ইউনাইটেড নেশন্স,টু আর্জেন্টলি রিকগনাইজ দ্য বেঙ্গলি জেনোসাইড অ্যাজ এ ওয়ে টু পে ট্রিবিউট টু দ্য ভিকটিম অ্যান্ড টু হোল্ড পারপিট্রেটরস অ্যাকাউন্টেবল।'অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে আরও একটি বিবৃতি পাওয়া গেছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত 'জেনোসাইড ওয়াচ'-এর পক্ষ থেকে। বিশ্বব্যাপী গণহত্যা নিবারণের উদ্দেশ্যে গঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি সুস্পষ্ট ভাষায় লিখেছে :'দিস ক্রাইমস বাই দ্য পাকিস্তানি মিলিটারি ফোর্সেস কনস্টিটিউটেড দ্য ক্রাইম এগেইনস্ট হিউম্যানিটি অব মার্ডার,এক্সটারমিনেশন, ডিপোর্টেশন অব ফোর্সিবল ট্রান্সফার অব পপুলেশন, ইমপ্রিজনমেন্ট অব আদার সিভিয়ার ডিপ্রাইভেশন অব ফিজিক্যাল লিবার্টি, টর্চার, রেপ, সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স, পারসিকিউশন, এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স অব পারসন্স অ্যান্ড আদার হিউম্যান অ্যাক্টস।' জাতিসংঘ এ যাবৎ ঠিক কতটা দৃঢ়চিত্ত ভূমিকা রাখতে পেরেছে,বা তার মর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছে, সে বিতর্ক নিশ্চয় করা যায়। তার সিদ্ধান্ত, সাধারণ বা নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাাবগুলো সে কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, সেটিও আলোচনার যোগ্য বিষয় হতে পারে। কিন্তু যে বাংলাদেশ গণহত্যার শিকার, গণহত্যা দিবস পালন করে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে, যে দেশে হাজারো গণকবর ও বধ্যভূমি আজও ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; সেই বাংলাদেশ গণহত্যার স্বীকৃতি নিতে বিশ্ব সংস্থার ওপর কতটা চাপ প্রয়োগ করেছে- সেটিও কম আলোচনার বিষয় হবে না নিশ্চয়। জাতি হিসেবে আমাদের অবশ্যই পর্যালোচনা করতে হবে- বিশ্ব সংস্থার কাছ থেকে বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করতে আমরা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছি। হয়তো অনেকে বলবেন, বেশ দেরি হয়ে গেছে; আর হবে না। কিন্তু গণহত্যার মতো বিষয় কখনও তামাদি হয় না, হয়নি কখনও। তা হলে ১৯১৫-২৩ সালের আর্মেনীয় গণহত্যার স্বীকৃতি মিলত না। বাংলাদেশকে প্রথমত একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। লক্ষ্যে পৌঁছার পরিকল্পনাসূচি তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকারকে বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন জানাতে হবে। তথ্য, সাক্ষ্য ও যুক্তিসংবলিত আবেদন সরবরাহ করতে হবে। তৃতীয়ত, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। যেসব দেশ ও সংস্থা পাকিস্তানি গণহত্যার সমালোচক এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিল,তাদের সমর্থন আদায় করতে হবে। চতুর্থত, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে গণহত্যার বিবরণ সংযুক্ত করতে হবে। বড় বড় গণহত্যার স্থানসহ সারাদেশে গণহত্যার নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে জেনোসাইড আর্কাইভ। পঞ্চমত,বাংলাদেশকে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির সময় পাকিস্তান সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচার সংক্রান্ত যেসব বিবৃতি দিয়েছে, তা ব্যবহার করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আত্মরক্ষামূলক নয়, বরং ক্ষতিগ্রস্থ রাষ্ট্র হিসেবে সরব ভূমিকা পালন করতে হবে। পাকিস্তানকে মনে করিয়ে দিতে হবে-তারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে যে বর্বরতা ঘটিয়েছে, তা বাঙালি জনগোষ্ঠী ভোলেনি; ভুলবে না কখনও। ষষ্ঠত, প্রবাসী বাঙালি ও মানবতাবাদী বিশ্ব জনগোষ্ঠীকে এ আন্দোলনে যুক্ত করতে হবে।মনে রাখা দরকার, ১৯৭২ সালে 'দি ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট'-আইসিজে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে স্পষ্টাক্ষরে লেখা আছে- কীভাবে এ গণহত্যা ঘটানো হয়েছে। নারী-শিশু নির্বিশেষে কীভাবে নির্বিচার গুলিবর্ষণ, বোমা ও আগুন দিয়ে মুসলমান-হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে; নারীরা নির্বিচারে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।সব দেশেই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের স্বীকৃতি ও বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবতার লড়াই, মানব সভ্যতার লড়াই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও আছে জাতীয় ইতিহাসের লড়াই। অতএব,বাঙালি গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টি নিছক কোনো দবি নয়। এটি গণহত্যার মতো অপরাধের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে জাগিয়ে তোলার লড়াই; যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে ঘৃণা করার লড়াই। অতএব, এর থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ কোথায়? হারুন হাবীব: মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক  
Link copied!