শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চৌধুরী, ফকির,বসু কিংবা তালুকদার বংশ পদবী কিভাবে আসে

প্রকাশিত: ০৮:৫৭ এএম, ডিসেম্বর ২০, ২০২১

চৌধুরী, ফকির,বসু কিংবা তালুকদার বংশ পদবী কিভাবে আসে

ডেইলি খবর ডেস্ক: চৌধুরী, ফকির, বসু কিংবা তালুকদার বংশ পদবী কিভাবে আসে।পালদের আমল থেকে সেন যুগ তারপর সুলতানি আমল থেকে ব্রিটিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে পদবীগুলো থিতু হয়েছে বলে ধরা হয়। আসুন, জেনে নেওয়া আসা যাক নির্দিষ্ট বংশ পদবীর কথায়। খুব বড় ইতিহাস নেই বাঙালির বংশ পদবীর। পালদের আমল থেকে সেন যুগ তারপর সুলতানি আমল থেকে ব্রিটিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে পদবীগুলো থিতু হয়েছে বলে ধরা হয়। পদবীর সঙ্গে পেশা, বসতিস্থানের যোগই বেশি। জমিজমা আর হিসাবের সঙ্গে জড়ানো পদবীর সংখ্যাও কম নয়। বল্লালসেনের আমলে যেমন ছত্রিশটি জাত সৃষ্টি করা হয়েছিল। সবগুলোর সঙ্গে পেশা আর গুণ যুক্ত। তবে সম্রাট গোপাল থেকে পাল কিন্তু বৌদ্ধদেরই অধিকারে থাকার কথা। খ্রিস্টান সমাজে পদবী এসেছে বিচিত্রভাবে। ডিকস্টা যেমন পর্তুগীজ ধর্মযাজকদেও দ্বারা ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের বোঝায়। আবার ডি রোজারিও বোঝায় রোজারিও দ্বীপ থেকে আগত ধর্ম যাজক দ্বারা ধর্মান্তরিত ব্যক্তি। ডি মানে আসলে দ্বীপ। এবার আসা যাক নির্দিষ্ট বংশ পদবীর কথায়। চৌধুরী: অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর নাম কে না জানে। চঞ্চল শব্দের মানেও আমাদের অজানা নয় তবে চৌধুরীর ইতিহাস জানার কৌত'হল বুঝি অনেকের মেটেনি। মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এ পদবী ব্যবহার করেন। উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই সম্ভ্রান্ত অনুভব হয় শ্রোতার মনে। সংস্কৃত চতুর্ধর, ভেঙে চতুর+ধর হয়ে চৌধুরী এসেছে। গোড়ার দিকে মুঘল সম্রাটরা এ পদবী দিয়ে সম্মানিত করতেন কোনো ব্যক্তিকে। ব্যক্তিটিকে বোঝাতে চর্তুসীমানার শাসক। তাই দেখতে পাই বাংলা অধিকাংশ শাসকদের পদবী চৌধুরী। তবে কেউ কেউ মনে করেন চৌথহারী মানে এক চতুর্থাংশ রাজস্ব আদায়কারীর উচ্চারণ পরিবর্তিত হয়ে চৌধুরী এসেছে। তাহলে ধরতে হয় চৌধুরী বাংলা মুল্লুকেরই নিজস্ব শব্দ। ওদিকে বঙ্গীয় শব্দকোষ জানাচ্ছে চতুর মানে তাকিয়া বা মসনদ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর মানে ধারক আর দুয়ে মিলে হয়েছে চৌধরি শেষে চৌধুরী। সেক্ষত্রে তা হিন্দি ও মারাঠি শব্দ। ব্রিটিশ আমলে চৌধুরী ব্যপকভাবেই হয়ে ওঠে সামন্ত রাজার পদবী। আরো একদিকের খবর হলো, ক্ষত্রিয়দের মধ্যে চৌধুরীর প্রচলন ছিল। যে সেনা কর্মকর্তা চারটি বাহিনী মানে নৌ, পদাতিক, অশ^ারোহী বাহিনী এবং হস্তি বাহিনী পরিচালনা করতেন তাকে বলা হতো চৌধুরী। তবে লোকশ্রæতি ছাড়া এর খুব বেশি ভিত্তি নেই। শেখ: ভালোবেসে শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা বঙ্গবন্ধু ডাকি। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। শেখ সোজা আরবী থেকে আসা পদবী। এ দিয়ে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদেরই বোঝায়। আরবদেশে গোত্র প্রধান বা গোত্রের বয়স্ক লোকদের শেখ বলে ডাকা হতো। নবীজি (স:) যাকে বা যাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন তিনি বা তাঁদের বংশধরও শেখ পদবী লাভ করতেন। বাংলাদেশের শেখরা অবশ্য ধারণা পোষণ করেন না যে তাঁদের পূর্ব পুরুষ সৌদী আরব থেকে এসেছে। অধিকাংশ সৈয়দরা যেমনটি করে থাকেন। তবে নেপথ্যে কিন্তু ওই একই চেতনা। নবীজির হাতে মুসলমান না হলেও বাংলায় ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে যারা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে নেন,প্রাচীন ও মধ্যযুগে তারা শেখ পদবী ধারণ করে ছিলেন। এমনিতেও কিন্তু অন্য ধর্মের লোকেরা মুসলমান বলতে শেখ বা সেক বুঝে থাকেন। বিশ্বাস: বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এ পদবী অনেক দেখা যায়। কায়স্থরাই বেশি ব্যবহার করে। নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মধ্যেও এর প্রচলন দেখা যায়। মুসলমান ও খ্রিস্টান বাঙালির মধ্যেও আছে কিছু। বিশ্বাসের অর্থ আস্থা বা বিশ্বস্বতা। বাংলা মুলুকে সরকারি প্রশাসনিক পরিষেবায় যারা অবদান রেখেছেন তাদের পদবী বিশ্বাস। মানে প্রাপ্তি এবং ব্যয়ের কাজে নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্মানিত করতে এ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। এ পদবীর একজন এখন আমাদের খুব চেনা, নাম অপু বিশ্বাস। তিনি একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। দাস বা দাশ: গবেষকরা মনে করেন দাশ যারা লেখেন তাঁরা এসেছেন ধীবর সম্প্রদায় থেকে। কবি জীবননান্দ দাশের কথা এখানে মনে পড়ছে। ওদিকে ভারতের উড়িষ্যার বৈদিক ব্রামহণরা দাবী করেন তাঁরা দশসংস্কার নৈপুণ্যে দাশ উপাধি পেয়েছিলেন। অন্যদিকে দাস এসেছে ভৃত্যশ্রেণী থেকে। কিন্তু অযোধ্যার পুরোহিতরা এটা মানতে নারাজ। তাঁরা নিজেদের বলেন ভগবানের দাস। আরেকটু খতিয়ে দেখলে, ভারতে জেলেদের পদবী হলো জলদাস আর মুচিদের রবিদাস। সেক্ষেত্রে নিম্নবর্গের প্রসঙ্গটি আবার সামনে আসে। বেনী মাধব দাস ব্রিটিশ ভারতের একজন পন্ডিত ব্যক্তি। চট্টগ্রাম জেলায় তাঁর জন্ম ১৮৬৬ সালে। শরৎচন্দ্রবসুসহ আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির গুরু তিনি। ফকির: মুসলমানদের পদবীটি এসেছে সন্ন্যাসবৃত্তি থেকেই। মরমী সাধকরা ফকির পদবী গ্রহণ করতেন। আরবী এ শব্দের আসল অর্থ নিঃস্ব। দরবেশ যারা এদেশে এসেছিলেন তাঁরা ফকির নামেই পরিচিতি পেয়েছেন। এছাড়া বিশেষ কোনো ধর্মেও অনুসারী না হয়ে যার সকল ধর্মেও মূলনীতি নিয়ে আত্মতত্ত্ব সন্ধান করেন তাদের পদবী ফকির। আবার সুফি বা বাউল তত্ত্ব বিশ^াসীরাও ফকির। ফকির বিদ্রোহের নেতা মজনু শাহের কথা আমাদের জানা। ফকির আলমগীরও আমাদের অনেক পরিচিত। তালুকদার: খুব পরিচিত একটি পদবী আমাদের দেশে। মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব ও ভ'মি সংক্রান্ত বিষয়াদি থেকে যেসব পদবীর উৎপত্তি তার মধ্যে তালুকদার অন্যতম। তালুক শব্দটি থেকেই এর ভিতরের কথা টের পাওয়া যায়। আরবি শব্দ তা'আল্লুকের অর্থ হচ্ছে ভ'-সম্পত্তি আর এর সঙ্গে যুক্ত হলো ফারসি দার। আসলে যিদি তালুকদার তিনি জমির বন্দোবস্ত নিতেন সরকারের কাছ থেকে যেমন, তেমনি জমিদারের কাছ থেকেও। ফলে তিনি হতেন উপজমিদার, তালুকদার এসেছে সে অর্থেই। মন্ডল: এটি বেশ পুরোনো পদবী ধারণা করা চলে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজেই এর প্রচলন দেখা যায়। সাধারণভাবে অনানুষ্ঠানিক গ্রাম-প্রধানকেই মন্ডল বলা হয়। তাঁরা আগে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। মন্ডলীয় কাজ করে তাঁরা অনেক অধিকার ভোগ করতেন। খাজনা আদায়কারী ও রায়তদের মধ্যস্থতা করা অথবা গ্রামীণ বিবাদ আপোস মীমাংসা করতে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতেন।তাঁদের অধীনেক পাটোয়ারি,তহসিলদার,চৌকিদাররাও কাজ করতেন। সরকার ও প্রজাদের মধ্যকার মানুষ আসলে মন্ডল। বসু: সম্ভ্রান্ত হিন্দু বাঙালি পদবী বসু। সংস্কৃত বাসু থেকে এর উৎপত্তি। এটি বিষ্্নুর একটি নাম যার অর্থ সবের মধ্যেই বসবাস। অনেকে আবার একে মহাদেব বা শিবেরও এক নাম বলে উল্লেখ করেছেন। বাসু শব্দের সঙ্গে সম্পদ, রতœ ইত্যাদিরও যোগ আছে। মূলত কায়স্থরা এ পদবীর অধিকারী। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকে বাংলায় কায়স্থদের উত্থান। তাঁরা গৌতম গোত্রের কুলীন কায়স্থ,ঘোষেরা,মিত্ররা আর গুহরা যেমন।কলকাতার বাগবাজারের বসুবাটি খুব বিখ্যাত। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এই বাড়ির সন্তান। শ্রীরামকৃষ্ন নন্দলালের সংগৃহীত দেবতাদের ছবি দেখতে এ বাড়িতে এসেছিলেন । সেন: সংস্কৃত সেনা থেকে সেন পদবী এসেছে বলেই বেশিরভাগের মত। ইংরেজী আর্মিকে আমরা বাংলায়ও সেনা বলছি। এটা আসলে সংস্কৃত শব্দ। ব্রাম্মন রাজপুরুষরা সেন পদবটি প্রথম গ্রহণ করেন। নিজেদের তাঁরা উঁচুজাতের ক্ষত্রিয় দাবী করতেন । মজার ব্যাপার হলো সেন পদবীধারী লোক সুইজারল্যান্ডেও মেলে। চীনেও সেনরা আছেন। তবে বানান লেখা হয় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। চীন প্রজাতন্ত্রেও প্রথম রাষ্ট্রপতি সান ইয়াত সেনকে অনেকেই চিনবেন। তিনি মাঞ্চু রাজবংশের অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেনের কথাও এখানে অবধারিতভাবেই আসে। এমন অনেক পদবী ধরে আছে বাঙালি। কেউ কেউ বংশ ধরে খোঁটাও দেন, আবার বংশ নিয়ে ভাবও দেখান অনেকে। খান, মোগল, পাঠান, গাজী, কাজী কিন্তু সরাসরি বিদেশি পদবী। খান পদবী যেমন আফগান মুল্লুক থেকেই এসেছে। চেঙ্গিস খানের সঙ্গেও একে জড়ান অনেকে। হাজরা, হাজারী, মোড়ল, মল্লিক, সরকার, পোদ্দার কিন্তু জমি-জমা বিষয়ক পদবীই। ওদিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় আর মুখোপাধ্যায় কিন্তু কতগুলি গ্রাাম গোত্র থেকেই এসেছে। যেমন বন্দ্যঘটি গ্রামের কুলীন ব্রাম্মনহরা শুরু করেছিলেন বন্দ্যোপাধ্যায় পদবীর। আবার চটুতি বা চট্ট থেকে উদ্ভুত চট্টোপাধ্যায়। গাঙ্গুর বা গঙ্গ গ্রামের বসতি থেকে এসেছে গঙ্গোপাধ্যায় এবং মুকুটি বা মুখটি অঞ্চলের বসতি থেকে ছড়িয়েছে মুখোপাধ্যায়। এছাড়া বাদর গ্রাম থেকে ভাদুড়ী পদবীর জন্ম।সুত্র-টিবিসি
Link copied!